অথ বৈধব্য কথা
উনিশ শতক। বাঙালির স্বপ্নদেখার শুরু। একটা জুতসই তারিখও উল্লেখ করা যায়, ২০ জানুয়ারি, ১৮১৭। এই তারিখেই স্বপ্ন দেখার আঁতুড়ঘর হিন্দু কলেজের জন্ম। যে হিন্দু কলেজের ছাত্রদের সম্পর্কে লর্ড ডালহৌসিকে সতর্ক করে টমাস উড বলেছিলেন : ‘Your Bengalees reading Bacon and Shakespeare – future detractors, opponents and gurmblers.’ ইংরেজদের পাশে বসার মত যোগ্যতা অর্জন করতে পেরে বঙ্গসন্তানদের বুক তখন গর্বে স্ফীত। তবে দীর্ঘকালের বন্ধ দরজা খুলল বটে, কিন্তু ভেতর বাড়ির শেকল আঁটা মহলে তখনও হাজার বছরের চাপা অন্ধকার। কুসংস্কার লক্ষ্মী তার সাবেকি রাজসিংহাসনে বসে অভিজাত পরিবারের কলাগাছের মত থামওয়ালা বাড়ি থেকে মধ্যবিত্তের সাধারণ ঘরকন্না বা গরিবের নুন আনতে পান্তা ফুরানোর সংসার – সবখানেই খুব জাঁকজমকের সংগে রাজত্ব চালাচ্ছেন। অর্থনৈতিক বা শৈক্ষিক প্রতিবেশ যাই হোক এক বিশেষ ক্ষেত্রে সেকালের বাঙালি পরিবারের পারিবারিক ইতিহাস অভিন্ন। কুলীন অথবা অ-কুলীন, সামাজিক পরিচিতিকে তুচ্ছ করে প্রতি সংসারেই তখন এক বা একাধিক বিধবা নারী। সামাজিক অথবা পারিবারিক সবধরণের অধিকার থেকে বঞ্ছিত এই অসহায় বিধবাদের দুঃখগাথা আজ আর কারো অজানা নয়। দৈনন্দিন জীবনে এদের লাঞ্ছনা অধীনতা আর অপমান-কথা শুনলে মনে হয় কোনো গল্প উপন্যাসের কাহিনী। এই লেখায় সামাজিক ভাবে অত্যাচারিতা অসহায় বিধবাদের কথা যেমন বলার চেষ্টা করেছি তেমনি সেকালের ব্যতিক্রমী কিছু বিধবাদের কথাও রয়েছে। যারা সংখ্যায় নগন্য হলেও নিজেদের চেষ্টায় অথবা সহৃদয় ব্যক্তিদের আনুকূল্যে নিজেদের অবস্থান থেকে উত্তরণের পথ খুঁজেছিলেন। সময়ের নিরিখে তাঁদের এই সাহসী পদক্ষেপ আমাদের আজও রোমাঞ্ছিত করে। মূলত উনিশ শতকেরই কিছু জীবনস্মৃতিমুলক রচনা থেকে কাহিনী গুলি সংগৃহীত। পাশাপাশি অন্যান্য বইয়েরও সাহায্য নেওয়া হয়েছে।
“স্বামীর মৃত্যুর দিন পনের পরেই আমার সেজ দেবর প্রথম আমার উপর অত্যাচার আরম্ভ করেন। তেতালার ঘরে যে বড় খাটে আমার স্বামী শুইতেন, ঘরের কপাট ভাঙ্গিয়া সে খাট খানি আমার সেজ দেবর লইয়া গেলেন, আমি কাঁদিলাম। জিনিসের লোভে যে আমি কাঁদিলাম তাহা নয়, কাঁদিলাম এই জন্য যে, তিনি যাইতে না যাইতেই ইঁহারা আমার সঙ্গে এইরূপ ব্যবহার করিতে আরম্ভ করিলেন। আমার শাশুড়ী মাথা খুঁড়িতে লাগিলেন। তাহাতে আমার বড় ভয় ও দুঃখ হইল। ভাবিলাম, আমি কেন কাঁদিলাম। তাতেই ত তিনি কষ্ট পাইলেন। মনকে বলিলাম, তাঁহাদের ভাইয়ের জিনিস তাঁহারা লইবেন, আমি কেন দুঃখ করিব ? আমি ত বাপের বাটী হইতে আনি নাই।”
ঘটনার বিবরণ দিচ্ছেন সারদাসুন্দরী দেবী (যোগেন্দ্রলাল খাস্তগীর অনুলিখিত সারদাসুন্দরীর ‘আত্মকথা’)। সম্ভ্রান্ত ঘরের পুত্রবধূ। মাত্র ন’বছর বয়সে কলকাতার বিখ্যাত ধনী দেওয়ান রামকমল সেনের মেজো ছেলে প্যারীমোহন সেনের সঙ্গে তাঁর বিয়ে। স্বামীর উৎসাহে কিছুটা লেখাপড়াও শিখেছিলেন। সাত সন্তানের জন্মের পর তাঁর উনত্রিশ বছর বয়সে হঠাৎ করেই প্যারীমোহনের মৃত্যুতে সারদাসুন্দরীর জীবনে নেমে আসে দুর্যোগ। এই দুর্যোগের শুরুর ঘটনা প্রথমেই উল্লেখ করা হয়েছে। স্বামীর খাটের পর তাঁর ব্যবহার করা শালদুটিও নিয়ে যাওয়া হল। এবার আর ধৈর্য ধরতে পারেননি সারদা। স্বামীর স্মৃতি হিসেবে বারবার শাল দুটি ফেরত পাবার জন্য আর্তি জানালে একটি শাল ফেরত পাওয়া যায়। অত্যাচারপর্ব অবশ্য এখানেই শেষ হয়নি। সারদাসুন্দরীর সেজো মেয়ে চূণী ছিলেন খুবই সুন্দরী। স্বাভাবিকভাবেই এক বিশাল অবস্থাপন্ন ঘরে তাঁর বিয়ে ঠিক হয়। কিন্তু ভাসুর সেই বিয়ে ভেঙে সারদাসুন্দরীর মৃতদার বড় জামাই লক্ষ্মীনারায়ণের সঙ্গে চূণীর বিয়ে দেন। এত সম্পদশালী পরিবার কিন্তু বিয়েতে চূণীকে ভাসুর এবং দেবররা একটি কাপড়ও দেননি বলে সারদাসুন্দরীর মনে আজীবন একটা ক্ষোভ ছিল। এমনকি তাঁর বিখ্যাত ছেলে ব্রহ্মানন্দ কেশবচন্দ্র সেনের জন্য হাঁড়েলার এক কুলীন পরিবারের পরমাসুন্দরী মেয়ের সঙ্গে যখন বিয়ের প্রস্তাব আসে তখনও ভাসুর সেই বিয়ে ভেঙে নিজের সেজ ছেলের সঙ্গে এই মেয়ের বিয়ে দেন। আর কেশবচন্দ্রের বিয়ে হয় ভাসুরের পছন্দ করা বালির চন্দ্র মজুমদারের মেয়ে গোলাপসুন্দরীর সঙ্গে। এই প্রসঙ্গে সারদাসুন্দরী বলেছেন, “বৌ-এর মুখ দেখিবার পুর্ব্বে আমার মন আরও খারাপ হইল, এমন কি কাঁদিয়া ফেলিলাম।“ কান্নার কারণ আর কিছুই নয়, “বিবাহের সময় বৌ অতি ছোট, রোগা ও কাল ছিলেন, মাথার চুল আদপেই ছিল না।“ সম্পত্তি ভাগের সময়ও দেওয়ান রামকমল সেনের পৌত্র প্যারীমোহনের ছেলেরা কিছুই পেলেন না। এবারও ভাসুরের মুখে শোনা গেল, “ তোমাদের ভাগ আমার কাছে রহিল।“ আরও অনেক অত্যাচার অপমান সারদাসুন্দরীকে নীরবে সহ্য করতে হয়েছিল। এমনকি কেশবচন্দ্র ব্রাহ্ম ধর্ম গ্রহণ করলে পারিবারিক অত্যাচার মূলত তাঁর উপরেই নেমে আসে। কিন্তু এত অত্যাচার সহ্য করেও কোনোদিন তাঁর মনে হয়নি যে কেশব কোনো ভুল কাজ করছেন। সেকালে ব্রাহ্ম ছেলের ছোঁওয়া অন্ন মা বাবারা পর্যন্ত স্পর্শ করতে্ন না। কখনো ধর্মান্তরিত ছেলে বাড়িতে ফিরে এলে অন্দরমহলে প্রবেশের অধিকার থেকেও সে বঞ্ছিত হত। এমনকি বাহির মহলে ভাত খেয়ে তাঁরা নিজেদের উচ্ছিষ্ট নিজেরাই পরিষ্কার করতেন। শিবনাথ শাস্ত্রীর আত্মজীবনী সূত্রে জানা যায় তাঁর বাবা ব্রাহ্ম ছেলেকে হত্যা করার জন্য ভাড়াটে গুণ্ডা পর্যন্ত লাগিয়েছিলেন। এমনতর পারিপার্শ্বিক অবস্থায় অন্তঃপুরচারিণী এক মহিলার পক্ষে এই ধর্মীয় সংস্কার আন্দোলনকে মন থেকে মেনে নেওয়া সোজা কথা নয়। অভিজাত পরিবারের বিধবা বধূর যদি এই অবস্থা হয়, সাধারণ পরিবারের বিধবাদের অবস্থা সহজেই অনুমেয়।
রসরাজ অমৃতলালের মা মাত্র ছাব্বিশ বছর বয়সেই বিধবা হন। দুর্ভাগ্যই বলতে হবে সেই মাসেই হয় তাঁর কলেরা। সদ্যবিধবার এই নিদারুণ শারীরিক অসুস্থতায় চিকিৎসার যে বিধান হয় তাঁর প্রত্যক্ষদর্শী ছিলেন অমৃতলাল। মায়ের এই কষ্টে স্বাভাবিক ভাবেই পুত্রের প্রাণ কেঁদে উঠে :
নগরে নিদাঘ জৈষ্ঠ দিবা দ্বিপ্রহর
বিসূচিকা তৃষা তাতে কত ভয়ঙ্কর
শক্তি বুঝিবারে বুঝি সদ্যো বিধবার
সেইদিন একাদশী পড়েছে আবার।
ভিষক আসিয়া গেল লিখিয়া ঔষধ
একে একাদশী তায় ‘ডাক্তারের মদ’।
উড়িল ব্যবস্থাপত্র বাতাসে উঠানে,
কাকীমা জলের ফোঁটা দেন মার কানে।
পাথরে রাখিয়া জল উদরে বসায়
জননী জীবন পান ঈশ্বর কৃপায়।।
পবিত্র প্রতিমা হেন নাহিক ধরায়
বঙ্গের বিধবা পাশে দেবী হেরে যায়।
ভেঙো না প্রতিমা চারু, মুছো না এ ছবি।
গলায় কাপড় দিয়ে পায়ে ধরে কবি।।
এই কবিতা যেন সমাজের হয়ে কবিরই পাপস্খলণ। সুদক্ষিণা সেন তাঁর ‘জীবনস্মৃতি’তে লিখেছেন, “সে’কালে বিধবাদের নির্জ্জলা একাদশী করিবার নিয়ম ছিল। এই কুসংস্কারটি লোকের মনে এত দৃঢ়বদ্ধ হইয়াছিল যে, একাদশীর দিন কোন বিধবার মৃত্যু হইলেও একবিন্দু জল তাঁহার কণ্ঠ ভিজাইতে পারিতেন না। এমন কি একাদশীর দিনে মৃতা হতভাগিনী বিধবার চিতাভষ্মও ধুইবার নিয়ম ছিল না।”
এই সুদক্ষিণা সেন শিক্ষানুরাগী অম্বিকাচরণ সেনের স্ত্রী।আরও অনেক ব্রাহ্ম মহিলার মত তিনিও আত্মজীবনী লিখেছেন। কেশবচন্দ্র প্রতিষ্ঠিত ভারতাশ্রমে কিছুদিন ছিলেন বলে সেই আশ্রমের অনেক কথাও তাঁর আত্মকথা সূত্রে জানা যায়। সুদক্ষিণার মা নিত্যকালী ছিলেন খুবই সাহসী এবং বিরল ব্যক্তিত্বের অধিকারী। নিত্যকালীর বিয়ে হয় মাইজপাড়া গ্রামের বিখ্যাত কুলীন বংশের সন্তান জগবন্ধু গঙ্গোপাধ্যায়ের সঙ্গে। জগদ্বন্ধু কুলীন হলেও কৌলীন্য প্রথাকে ঘৃণাই করতেন। এমনকি ঘটকেরা যখন নিত্যকালীকে বিয়ের পরও প্রতিদিন নতুন নতুন কুলীন কন্যার বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে বাড়িতে আসতেন, তিনি ভয়ে বাড়ি ছেড়ে পালাতেন। এমনকি মাইজপাড়া কুসংস্কারাচ্ছন্ন গ্রাম বলে তিনি স্ত্রীকেও নিজের গ্রামের বাড়িতে খুব কমই নিয়ে গেছেন। বিয়ের পর তাঁর ইচ্ছায় নিত্যকালী লেখাপড়াও শিখেছেন। জগবন্ধুর স্বপ্ন ছিল দুই মেয়েকে শিক্ষিত করে বিয়ের উপযুক্ত বয়স হলেই তাদের বিয়ে দেবেন। কিন্তু স্বপ্ন পূরণের আগেই তাঁর মৃত্যু হয়। মৃত্যুকালে তিনি স্ত্রীকে বলে যান, “কন্যাদের লেখাপড়া শিখাইও ও বড় করিয়া বিবাহ দিও।” নিত্যকালী সন্তানদের নিয়ে সোহাগদলে পিতৃগৃহেই থেকে গেলেন। জগবন্ধুর ভাইরা মৃত দাদার পরিবারের দায়িত্ব না নিলেও ভাইপো গোবিন্দবন্ধু একটু বড় হতেই কাকারা এসে উপস্থিত কুলপ্রথা মেনে বংশজ কন্যার সঙ্গে তাঁর বিয়ে দেবার জন্য। বিধবা ভ্রাতৃবধূকে তারা স্পষ্ট জানিয়ে দেন যে ‘একটি অকুলীন কন্যার ভার প্রথমে লইতে হইবে। পরে ইচ্ছা করিলে কুলীন কন্যা বিবাহ করিতে পারিবে।’
পূর্ববঙ্গের কুলীনদের মধ্যে ‘করণ’ নামে এক বিশেষ প্রথা প্রচলিত ছিল। যার অর্থ কুলীন পাত্রের কুল ভঙ্গ করা। এই প্রথা অনুযায়ী পূর্ববঙ্গের অকুলীন ধনী ভূস্বামীরা বংশ মর্যাদা বৃদ্ধির জন্য গরীব কুলীন পাত্রদের সঙ্গে বিশাল অর্থের বিনিময়ে তাঁদের পরিবারের মেয়েদের বিয়ে দিতেন। বিয়ের আগে মেয়ের আত্মীয়রা গুরু ও পুরোহিত সঙ্গে নিয়ে নদী বা পুখুরের মাঝখানে একটি হাঁড়িতে চাল-তিল ইত্যাদি ভরে ভাবি জামাইয়ের কুল অতল জলে ডুবিয়ে আসতেন। এই অনুষ্ঠানই ‘করণ’। হাইকোর্টের বিচারপতি আশুতোষ চৌধুরী, সবুজপত্রের প্রমথ চৌধুরীর দিদি, কবি প্রিয়ংবদা দেবীর মা প্রসন্নময়ীর এই করণ প্রথা মেনেই বিয়ে হয়। প্রসন্নময়ীর আত্মজীবনী সূত্রে জানা যায়, তাঁর চার পিসির মধ্যে তিন পিসির করণ প্রথা মেনে কুলীন বর জুটলেও ছোট পিসি মৃন্ময়ীর জন্য উপযুক্ত কুলীন পাত্র পাওয়া না যাওয়ায় বিপত্নীক বৃদ্ধ পিসেমশাইর সঙ্গেই তাঁর বিয়ে দিয়ে দেওয়া হয়। পুর্ববঙ্গের অর্থলোভী এই কুলীনেরা প্রথমে করণ প্রথা মেনে কুলমর্যাদাহীন বংশজ ধনী কন্যাকে বিয়ে করার পর যতখুশি কুলীন কন্যা বিয়ে করতেন, কারণ কুলীন পিতারাও যথেষ্ট অর্থ ব্যয় করতেন স্বঘরে কন্যার বিয়ে দেবার জন্য।
নিত্যকালী ভয় পেলেন। পুত্র গোবিন্দবন্ধুর পর পাছে তাঁর মেয়েরা কুলীন কাকাদের কুসংস্কারের শিকার হয়ে সপত্নী গৃহে যেতে বাধ্য হয় এই ভয়ে তিনি এক দুঃসাহসী কাজ করেন। বাড়ি থেকে পালিয়ে ব্রাহ্মসমাজের আশ্রয় নিয়ে দুই কন্যাকে অসম সাহসিকতার সঙ্গে কুলমর্যাদা অগ্রাহ্য করে বিয়ে দেন বৈদ্য ও কায়স্থ পাত্রের সঙ্গে, যাতে আর কৌলীন্য প্রথার ভয় না থাকে। এই কন্যাদের অন্যতমা সুদক্ষিনা সেন। তাঁর বিয়ে হয় শিক্ষানুরাগী অম্বিকাচরণ সেনের সঙ্গে। সুদক্ষিণা কেশব সেনের নারীবিদ্যালয়ে পড়াশোনা করেছেন। খরচ কমানোর জন্য নিত্যকালী কলকাতা ছেড়ে ঢাকায় চলে এলে তিনি আশ্রয়দাতা পরিবারের সমস্ত রান্না এবং খাবার পরিবেশন শেষ করে ঢাকার ‘এডাল্ট ফিমেল স্কুলে’ পড়তে যেতেন। নিত্যকালী নিজেও বৃত্তি পেয়ে বেথুন স্কুলের ছাত্রী হয়েছিলেন। যদিও শারীরিক অসুস্থতার কারণে তিনদিনের বেশি স্কুলে যেতে পারেননি। সুদক্ষিনা ‘জীবনস্মৃতি’তে মার কথা বলতে গিয়ে লিখেছেন, “যে সময়ে কুসংস্কার ছিল যে মেয়েরা লেখাপড়া শিখিলেই বিধবা হয়, সেই সময় আমার মাতৃদেবী আমাদের লেখাপড়া শিখাইতে চেষ্টা করিয়াছিলেন। তিনি গ্রামের লোকের নিন্দাবাদ গ্রাহ্য করেন নাই।”
সুদক্ষিণা সেনের ‘জীবনস্মৃতি’ সূত্রে আমরা পার্বতী নামে আর এক অসহায় বিধবার কথা জানতে পারি। সুদক্ষিণা তাঁর মামার বাড়ি সোহাগদলেই বড় হয়েছেন। তাঁদের প্রতিবেশী ছিলেন পার্বতী। সুদক্ষিণা তাঁকে পার্বতীমাসি বলে সম্বোধন করতেন। মাত্র আড়াই বছর বয়সে বিয়ে আর পাঁচ বছর বয়সে বিধবা পার্বতীর মড়ার উপর খাঁড়ার ঘায়ের মত ঘরে ছিলেন এক বিমাতা। বিমাতার মাত্রাজ্ঞান কম থাকায় অনেকসময় তার স্নেহের প্রকাশ বিপদসীমাকেও ছাড়িয়ে যেত। এ হেন নারকীয় জীবনে পার্বতীর একমাত্র সান্ত্বনার জায়গা ছিল প্রতিবেশী সুদক্ষিণাদের পরিবার। সেই পরিবার সূত্রেই ব্রাহ্ম সমাজের সাহসী কর্মকাণ্ডের কথা প্রথম তাঁর কানে আসে। এর পর থেকেই স্বপ্ন দেখার শুরু। যদি কোনোভাবে একবার ব্রাহ্মসমাজে আশ্রয় পাওয়া যায় তাহলে হয়ত এই নরকতুল্য জীবন থেকে মুক্তি পাওয়া সম্ভব। এক্ষেত্রে পার্বতীর ভাগ্যদেবতা তাঁর প্রতি সদয় ছিলেন। সুদক্ষিণার সম্পর্কিত মামা ভগবানচন্দ্র মুখোপাধ্যায় ছিলেন ব্রাহ্ম। তিনি সোহাগদল ঘুরতে এসে পার্বতীর দুঃখের কথা জানতে পেরে প্রতিজ্ঞা করেন, যে ভাবেই হোক পার্বতীকে উদ্ধার করতে হবে। এই উদ্দেশ্য নিয়ে নিয়ে তিনি ফিরে গেলেন এবং দুই বন্ধুকে নিয়ে আবার সোহাগদলে এসে গ্রামেরই এক নৌকা ভাড়া করে নদীতীরে গোপনে অপেক্ষা করতে লাগলেন। সুদক্ষিণার পরিবার মারফৎ খবর পেয়ে পার্বতী তৈরিই ছিলেন। কিন্তু বিধি বাম, এত করেও শেষ রক্ষা হলনা। পার্বতী নৌকায় চড়ামাত্র গ্রামের মাঝিরা তাঁকে চিনে ফেলে এবং গ্রামে খবর পাঠাবার সঙ্গে সঙ্গে তাঁর ভাই বন্ধুরা এসে চড়াও হলেন ভগবানচন্দ্র ও তাঁর সঙ্গীদের উপর। সে যাত্রায় উদ্ধারকার্য প্রহারের মাধ্যমেই সম্পন্ন হয়। পার্বতীর উপরও অত্যাচারের মাত্রা বাড়ে। খেতে বসলে তাঁর খাবার ফেলে থালায় ছাই ঢেলে দেওয়া হত। এমনকি তাঁর মাথায় সুন্দর লম্বা চুলকে পরপুরুষের কুদৃষ্টির জন্য দায়ী করে বঁটি দিয়ে সেই চুলও কুরুচিকর ভাবে কেটে ফেলা হয়। কিন্তু এত কষ্টেও পার্বতী নীরব। ভগবানচন্দ্রও হার মানার পাত্র নন। এবার তিনি দূর গ্রাম থেকে নৌকা ভাড়া করে গ্রামের বাজারে এসে বন্ধুদের নিয়ে অপেক্ষা করতে লাগলেন। সুদক্ষিণার মামা রাজকুমার মুখোটী বাজার করতে এসে তাঁদের সঙ্গে দেখা হলে তাঁকেই পাঠানো হয় পার্বতীর কাছে। তিনি এসে দেখেন পার্বতী ফুল তুলছে। তাঁকে সেই অবস্থায়ই নৌকায় তুলে দেওয়া হল। পার্বতীর পরিবারের লোকেরা আশেপাশে কোথাও পার্বতীকে খুঁজে না পেয়ে এবং বাগানে ফুলের সাজি পড়ে থাকতে দেখে সন্দেহ করেন যে হয়ত পার্বতীকে বাঘে খেয়েছে। অনেকদিন পর অবশ্য তাদের এই ভুল ভাঙে।
প্রমথ চৌধুরীর দিদি প্রসন্নময়ীও তাঁর ‘পূর্ব্বকথা’য় এক ব্যতিক্রমী শিক্ষিতা বিধবার কথা বলেছেন। প্রসন্নময়ীর ভাষা্তেই গল্পটা শোনা যাক। “কাশীশ্বরী সর্বাপেক্ষা পণ্ডিতা, ছোট ছোট বালকবালিকাগণ তাঁহার নিকট লেখাপড়া শিখিতে যাইত। অসহায় বালবিধবার রূপ বড় বিপদজনক, আত্মসম্মান রক্ষার্থে তাঁহাকে অনেক ক্লেশ স্বীকার করিতে হয়। শ্যামাঙ্গিনী কাশীশ্বরী যৌবনে অতিশয় সুরূপা ছিলেন, সুদীর্ঘ কুঞ্চিত কেশ, আয়ত লোচন ও সুঠাম, দীর্ঘ, পূর্ণ দেহ যষ্টি, দর্শকের দৃষ্টি আকর্ষণ করিত, এজন্য তাঁহার একাকিনী পথ ঘাটে চলাফেরা নিরাপদ না থাকায় তিনি কাহাকেও কিছু না বলিয়া এক নিশীথ রাত্রে পুরাতন বৃদ্ধা পরিচারিকা সহ জেলা কোর্টের জজ সাহেবের নিকট আশ্রয় ভিক্ষার আবেদন পত্রসহ যাইয়া উপস্থিত হন, তৎকালে তিন মাস পরে দায়রার বিচারার্থ জজ মহোদয় পাবনা আসিতেন, ইহার মধ্যে অন্যসকল কাজকর্ম রাজসাহীতেই হইত, ব্রহ্মবাদিনী অরুন্ধতীর ন্যায় তেজস্বিনী ব্রাহ্মণ কন্যাকে একাকী বিচারালয়ে দেখিয়া ও তাঁহার বিপন্নাবস্থার কাহিনী শ্রবণে দয়ালু জজ সাহেব এক ‘জরুরি পরোয়ানা’ গ্রামে পাঠাইয়া আজ্ঞা প্রদান করিলেন যে, “এই বিধবা কন্যার প্রতি কখন যদি কোনও রূপ অত্যাচার শুনিতে পান, তাহা হইলে বিনাবিচারে দোষীদিগকে ছয় মাসের জন্য শ্রীঘরে পাঠাইবেন।” জজ সাহেব সরকার হইতে দুঃখিনী বিধবাকে মাসিক পাঁচ টাকা বৃত্তি ধার্য্য করিয়া দিলেন।”
শুধু সেকালে নয়, বোধ হয় একালেও এই মহিলারা ব্যতিক্রম। এই ব্যতিক্রমী নারীদের সংখ্যা যথেষ্ট না হলেও নিতান্ত কম নয়। সবার কথা হয়ত উল্লেখ করা গেল না। জন্মমুহূর্ত থেকেই নানা সামাজিক প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে ভালো মেয়ে, ভালো বউ বা ভালো মা হওয়ার যে শিক্ষা পুরুষ শাসিত সমাজে মেয়েদের দেওয়া হয়, সরাসরি সেই প্রক্রিয়াকে অস্বীকার না করে এবং বৌদ্ধিক হাতিয়ারে সমৃদ্ধ না হয়েই সীমিত ক্ষমতায় পারিপার্শ্বিক অবস্থায় মাথা নত না করে মুক্তির যে চেষ্টা এই নারীরা করে গেছেন, সে কথা স্মরণ করে বলতেই হয় যে মূলত এদের হাত ধরেই বঙ্গে নারী জাগরণের সূচনা। অনুমান করতে পারি কাজটি সহজ ছিল না। শিলংপ্রবাসী সাধারণ ব্রাহ্মসমাজের সদস্য শারদামঞ্জরী দত্ত তাঁর আত্মজীবনী ‘মহাযাত্রার পথে’ গ্রন্থে লিখেছিলেন, “ আমার ইচ্ছা করে দেশের দুর্গতি দেখিয়া সর্বদা কাগজপত্রে ঐসব বিষয়ে প্রবন্ধ লিখিতে, বক্তৃতাদি দ্বারা দেশের লোকের মন হইতে ভ্রম ও কুসংস্কার দূর করিতে। কিন্তু সামান্য লেখাপড়া শিখিয়া এ সকল সহজসাধ্য নহে।” সহজ না হলেও তাঁদের চেষ্টাই আজকের মানবীকে স্বাধীনতার ধারণার অবস্থানকে চিহ্নিত করতে সাহায্য করেছে।