ছিন্নমূল ও উত্তরাধিকার



ছেলেবেলায় বাবা গল্প বলতেন । পূজোর ছুটিতে করিমগঞ্জ থেকে নৌকো করে বাংলাদেশের সেই কোন পঞ্চখন্ডের খসি গ্রামে যাবার গল্প । তখনও ভারত ভাগ হয়নি । দাদু চাকরী করতেন করিমগঞ্জের মুন্সেফ কোর্টে । আর বাবারা ক'ভাই পড়াশোনার জন্য থাকতেন তাঁর সঙ্গে । স্কুল ছুটি হলেই সবাই মিলে বাড়ির উদ্দেশ্যে নৌকোযাত্রা । নদীপথে দুরাত্তিরের যাত্রা । মাঝপথে নদীতীরে মাঝিদের রান্নার গল্প বলতে বলতে বাবার চোখ চিক চিক করে উঠত । বাড়ির ঘাটে পৌঁছে ফলবাগান আর চানের পুকুর , খাবার জলের পুকুর , ' রাইয়ত ' -দের আলাদা খাবার জলের পুকুর পেরিয়ে তবে না বিশাল ঠাকুরদালানে পৌঁছোনো -- ঘরে ফেরা । আমার কাছে তখন বাবার সেই বাড়ি মানেই চারপাশে ছড়িয়ে থাকা পুকুরের মাঝখানে এক বিশাল বাড়ি । বাবা আজীবন তাঁর সেই বাড়ির গল্প করে গেছেন । ফলবাগানের কথা , মাছ ধরা , রকমারি খেলাধূলা , দূর্গাপূজার আনন্দ উৎসব , ' রাইয়ত '- দের গল্প -- এগুলো ছিল তাঁর প্রিয় বিষয় । আর একটা গল্প বাবা খুব বলতেন । ভারতবর্ষ স্বাধীন হবার দিনের গল্প । কিছুদিন থেকেই কানাকানি শোনা যাচ্ছিল করিমগঞ্জ নাকি জুড়ছে পূর্ব পাকিস্থানের সঙ্গে । যথারীতি ভারত স্বাধীন হবার একদিন আগেই করিমগঞ্জে স্বাধীনতা এলো । দেশটা হয়ে গেল পাকিস্থান । বাবারা আগেই বাড়ির মহিলাদের শিলচরে জ্যেঠুর কাছে পাঠিয়ে নিজেরা ক'ভাই থেকে গিয়েছিলেন করিমগঞ্জে । স্বাধীনতা উৎসবের অঙ্গ হিসেবে সেদিন জকিগঞ্জে এক বিশাল ফুটবল ম্যাচ আয়োজিত হয়েছিল । বাবারা কয়েকজন আমন্ত্রিত হয়ে সেই ম্যাচ খেলতে গেলেন । অবশ্য পরে করিমগঞ্জ আবার ভারতের সঙ্গে জুড়ে গেলো । সে এক অন্য গল্প । যা বলছিলাম , এই গল্পগুলি বলতে বলতে বাবার চেহারাটা পাল্টে যেতে দেখেছি । গল্প বলার আনন্দের মাধ্যমে বাবা যেন ফিরে যেতেন তাঁর সেই স্মৃতির পুরোনো গ্রামে । ছেলেবেলায় এই গল্পগুলি ছিল আমার কাছে রূপকথার মত । অনেকবার শুনে শুনে গ্রামটির একটা ছবি মনের কোনে আঁকা ছিল । এখনও চোখ বুজে সেই ছবি স্পষ্ট দেখতে পাই । কিন্তু একই গল্পের পুনরাবৃত্তিতে বড় হয়ে মুগ্ধতা হারিয়ে গেলো । তখন বিরক্ত হতাম । কিন্তু এই প্রসঙ্গে বাবার উৎসাহে কোনোদিন ঘাটতি চোখে পড়েনি ।যতবার এই এক গল্প বলতে শুরু করেছেন , ঠিক প্রথমবারের উৎসাহ নিয়েই শুরু করেছেন ।

আজ বাবা নেই । আমরা এখন বড় হয়ে গেছি । তখন বুঝতে পারিনি , আজ বাবার ছিন্নমূল আত্মার মানসিক কষ্টকে উপলব্ধি করি। তবুতো বাবাকে উদ্বাস্তু হতে হয়নি , কিন্তু শেকড়টা উপড়ে ফেলতে হয়েছিল বৈকি । আজ যখন নিজের শেকড়টা উপড়ে ফেলে চলে আসতে হয়েছে অন্য এক নতুন পরিবেশে , তখন কোথায় যেন বাবার কষ্টের সঙ্গে নিজের কষ্টটা একাত্ম হয়ে যায় । বাবার মতো আমার দেশটা পালটে যায়নি ঠিকই , এমনকি আছি একই রাজ্যে -- তবু কেনো সইতে হয় এই শেকড় উপড়ানোর যন্ত্রনা !!! নতুন করে শেকড় চাড়িয়ে দিতে পারিনি বলে ? এ কোন উত্তরাধিকার ! কালপ্রবাহে এখন আমি বাবার ভূমিকায় । আমার ছোট ছেলে যথেষ্টই ছোটো । বড় ছেলেকে গল্প শোনাই আমার সেই মাতৃশহরের । সে এখন মুগ্ধ হয়ে শোনে । অভিজ্ঞতা থেকে জানি ওর সেই মুগ্ধতা বেশীদিন নয় । কিছুদিন পরে বিরক্ত হবে । তাতে আমার উৎসাহ কমবে কী ? এবং স্মৃতি । এখন পুরাতন এবং প্রচলিত সেই সত্যিকে অবলম্বন করার সময় হয়েছে -- নতুনকে আঁকড়ে ধরাই জীবনশিল্প । মন ঘোরাতে নতুন পরিবেশের ভালো সবকিছুর কথা ভাবি । আরো অনেকগুলো বছর এখানে থাকতে হবে যে ! মন ভালো রাখার এ এক উপায় । কিন্তু ' মন কি অত সহজ ব্যাপার ' !!!!!!!


( বাবার ভীষণ ইচ্ছে ছিল তাঁর সেই পুরোনো গ্রামকে ফিরে দেখার । কিন্তু ভৌগলিক বাঁধা তাঁর এই ইচ্ছেপূরণের অন্তরায় ছিল । অল্প আয়াসে হয়ত সেই অন্তরায় কাটিয়ে উঠা সম্ভব হত । কিন্তু তা আর হয়ে উঠেনি । আজ বাবার সেই একান্ত ইচ্ছে গোপনে নিজের মনে বহন করে চলি -- যদি একবার অন্তত সেই ' পুকুর ঘেরা গ্রামটিকে ' দেখে আসা যায় !!! )

4 comments:

Unknown said...

বাবার সেই 'খসি গ্রাম' হয়তো সেই রূপে নেই, কিন্তু তবুও মনের কোন এক গহন কোনে স্বপ্নের সেই গ্রাম আজও তাজা হয়ে আছে । হয়তো বা অতীতের সঙ্গে বর্তমানের সংঘাতে খানখান হয়ে যেতে পারে বাস্তবের সেই গ্রাম । কিন্তু শৈশব আর যৌবনের অব্যক্ত স্মৃতির প্রতীক হয়ে থাকবে সেই গ্রাম ...চিরকাল ।

Unknown said...
This comment has been removed by a blog administrator.
Shubhajit said...

Amio babar mukh theke shuni babar chhotobelar galpo, nanan mojar ghotona. Ichhe kore shob kotha, shob itihas kothao likhe rakhar. Hoyto ekdin likhbo, tatodin babader daoa, shei gram, thakurdar ghor shobi amar kalponar chalocchitro hoye thakbe. Ei shedin shunlam fulkaku Silhet ghure eshechen. Amaro ichhe hoy baba k niye jodi...

সুশান্ত কর said...

শেকড় উপাড়ানোটাই আজকের মানূষের ভবিতব্য! কিছু উপাড়ানো বোধহয় ভালো! এবারে দিন পনেরর জন্যে শিলচর, করিমগঞ্জ, বদরপুর ভ্রমণে গিয়ে তাই মনে হলো! কী কূপমন্ডুক ওখানকার লোকগুলো! রাস্তাঘাট পঁচে গেছে আর দিসপুরের ঘাড়ে দোষ চাপিয়ে গৌতম-সন্তোষের ঘাড়ে মাথা রেখে দিব্বি ঘুমিয়ে আছে আমাদের উপত্যকা! তোমার ব্লগ ভালোই এগুচ্ছে! তোমার শ্বশুর বাড়িও গেছিলাম! বেশিক্ষণ বসতে পারিনি!

যাঁকে ঘিরে আমার অস্তিত্ব ...

যাঁকে ঘিরে আমার অস্তিত্ব ...