কবিতা : পাঠ পাঠক পুনর্জন্ম



নে পড়ছে বার্ট্রান্ড রাসেলের সেই বিখ্যাত প্রশ্ন : একজন লোক একটা নদীতে ক'বার অবগাহন করতে পারে ? প্রশ্নটা খানিকটা উদ্ভট ঠেকতেই পারে , অন্তত যতক্ষণ না প্রশ্নের উত্তরটা জানা যায় ! উত্তরটা অবশ্য রাসেল নিজেই দিয়েছেন -- কোনোও একটা নদীতে মত্র একবারই অবগাহন সম্ভব কেননা নিয়ত বহমান নদীতে জল তো আর স্থির থাকছে না , প্রতিমুহূর্তেই নতুন জলস্রোত এসে পুরোনো জলের জায়গা নিয়ে নিচ্ছে আর , নতুন জলস্রোত মানেই তো নদীর চরিত্র পালটে যাওয়া -- একধরনের পুনর্জন্ম -- এক নতুন নদী হয়ে ওঠা তাই দ্বিতীয়বার কেউ যখন ঐ নদীতেই ডুব দেয় , প্রকৃতপক্ষে তা হয়ে ওঠে এক ' অন্য ' নদীতে ডুব দেওয়ার সামিল

কিছু কিছু ভালো-লাগা কবিতাও ওরকমই । পুনঃপাঠে , প্রতিবারই যেন পুনর্জন্মের অনুভূতি নিয়ে ধরা দেয় মননে -- হৃদয়ে । কবিতার সার্থক হয়ে ওঠার মর্মকথা লুকিয়ে আছে এখানেই -- এই রহস্য মেদুরতায় , এক নতুনতর আখ্যান হিসেবে নিজেকে বারংবার উন্মোচিত করার ক্ষমতায়। এ কবিতা সমালোচকের মুখাপেক্ষী নয়,
তত্ত্বাভিলাষীও নয় । সে শুধু কবি্তা পাঠকের । ভালো লাগার । ভালোবাসার । আর আবিষ্কারের ।

এই আবিষ্কারের আনন্দ যে বুদ্ধিমান থেকে হৃদয়বান সবাইকে সমানভাবে ছুঁয়ে যাবে , এমন নয় । আবার , কবিতার আবেদন কতটা বোধের কাছে আর কতোটাই বা হৃদয়ের কাছে তা বলাটাও মুশকিল । কিন্তু নিজের এবং পরিপার্শ্বের অস্ত্বিত্ত্ব সম্পর্কে যারা সংশয়দীর্ণ নন , তাদের কাছে কবিতার রহস্যাতুর অন্তঃশরীর অধরাই থেকে যায় । যে উত্থান-পতনভরা ধরাছোঁয়ার খেলার মধ্য দিয়ে এক বহুমাত্রিক উপলব্ধির দিকে এগিয়ে যান কবিতার পাঠক , তার মর্মে এই সংশয়েরই অধিষ্ঠান। এবং এই অভিযাত্রার শেষেও পাঠক উপনীত হতে পারেন সংশয়ে । ' যেন একই সূচনাকথা আবার পৌঁছল এসে শেষে ' ( জীবনানন্দ ) ।

কবিতাকেও ব্যাখ্যেয় করে তোলার যে চেষ্টা সমালোচকেরা যুগ যুগ ধরে করে আসছেন , তার স্বরূপ যদি ও পাল্টেছে বারবার , তার লক্ষ্য কিন্তু অপরিবর্তনীয়ই রয়েছে । অবশ্য সভ্যতার দীপায়ন বা এনলাইটমেন্ট পর্বের সূচনায় কল্পনা আর আবেগকে দূরে সরিয়ে রাখতে গিয়ে কবিতাকে মানবমনের নিতান্তই অসংস্কৃত প্রবৃত্তিজাত বলে চিহ্নিত করা হয়েছিল। পরবর্তীকালে কবিতার কনটেন্টই হয়ে ওঠে কেন্দ্রাভিগ সমালোচনা ধারার একমাত্র বিবেচ্য ।

আধুনিকতার পর্বে কবিতায় অর্থবহতাই তার সার্থকতার লক্ষণ হিসেবে পরিচিত হয়ে ওঠে । সমালোচনার সমাজতাত্ত্বিক মনোসমীক্ষণ কিংবা ধর্মবাদী চিন্তাধারায় বিশ্বাসী প্রত্যেকেই কবিতা আলোচনায় হয়ে ওঠেন ' অর্থ'-
সন্ধিৎসু । আধুনিকতার বিরোধিতায় মুখর হয়ে যখন আধুনিকোত্তরবাদ বা পোষ্টমডার্নিজমের অভিমুখ নির্মিত হলো , তখন তার ঝোঁক পরিলক্ষিত হলো আপেক্ষিকতার দিকে , নানা অভিমুখের বহুত্বময় জটিল বয়নে । ঘোষিত হলো ' অথর '-এর মৃত্যু । টেক্সটকে বি-নির্মাণ করে অর্থের অশেষ বিচরণের ক্ষেত্র প্রস্তুত হলো । সূচনা হলো ভাষার আলংকারিক প্রক্রিয়াকে বিশ্লেষণ করে তার পক্ষপাত ও অন্তর্লীন স্ববিরোধীতাকে একই সঙ্গে তুলে ধরার বহুমাত্রিক প্রচেষ্টার ।

কবিতা , বা যে কোনো সাহিত্যকর্মই , যতক্ষণ পর্যন্ত তার স্রষ্টার লেখার খাতায় রূপকথার সেই ঘুমন্ত রাজকন্যার মতো বন্দী , ততক্ষণ অব্দি তার ওপর স্রষ্টার প্রভুত্ব নিয়ে বিশেষ বিতর্কের অবকাশ নেই। কিন্তু যে মুহূর্তে মুদ্রণযন্ত্র নামক এক জিওন কাঠির ছোঁয়ায় জেগে উঠে তা পৌঁছে যায় এক বৃহত্তর পাঠক সমাজে , তখন তা কতোটা পাঠকের , কতোটা সমালোচকের , আর কতোটাই বা লেখকের নিয়ন্ত্রনাধীন -- এ প্রশ্ন কালে-কালান্তরে বহুবারই উঠে এসেছে বিতর্কের আঙ্গিনায় । দেরিদার অনুসারী আজকের আধুনিকোত্তরবাদীরা বলছেন পাঠকভেদে টেক্সট বা পাঠের চেহারা পাল্টে যেতে বাধ্য । কেননা লিখিত ভাষায় একটা অনধিগম্য দূরত্বের আড়াল রয়েছে , যা পাঠককে লেখকের অভিপ্রেত সত্যের চেয়ে অনেক দূরের এক অন্যতর সত্যে নিয়ে গিয়ে দাঁড় করায় । ফলে কোনও টেক্সটই লেখকের অভীষ্ট অর্থের দিকে পাঠককে নিয়ে যায়না , বরং পাঠান্তে সম্পূর্ণ বিপরীত কোনও অর্থও উঠে আসা সম্ভব । এভাবেও এক অর্থে পুনর্জন্ম ঘটে টেক্সটের ।

এই অর্থ-সন্ধিৎসার বিপ্রতীপে রয়েছেন সুসান সনটাগ । শিল্পসাহিত্যের ব্যাখ্যাতারা তাঁর ঘোর অপছন্দের । শিল্পে শুধু ' কনটেন্ট ' খুঁজে বেড়ানোর বিরোধী তিনি । তাঁর বিখ্যাত প্রবন্ধ সংকলন ' অ্যাগেনষ্ট ইন্টারপ্রিটেশন'-এর নামরচনায় সনটাগ চেয়েছেন আমরা যারা শিল্পসাহিত্যের অনুরাগী , তারা আরও একটু হৃদয়বেত্তা হই -- একটু বেশি করে দেখতে শিখি , শুনতে শিখি , অনুভব করতে শিখি । তবেই শিল্পসাহিত্য হয়ে উঠবে আনন্দোদ্দীপক । শুধু অর্থের নির্মিতির মধ্যে এই উদ্দীপনা নেই , রয়েছে এক ধরণের যান্ত্রিকতা ।

আজকের কবিতা পাঠকের কাছে এই জবানি বা ডিসকোর্সগুলো সবই গুরুত্বপূর্ণ । কিন্তু সম্ভবত একইসঙ্গে গুরুত্বপূর্ণ ' অ্যালিস ইন ওয়ান্ডারল্যান্ড '-এর স্রষ্টা ল্যিউস ক্যারলের সেই কল্পনাটির আবেদন যে , কোনও একটা বই একবার বন্ধ করে ফের খুললেই দেখা যাবে তার অক্ষরগুলো সব ঘেঁটে এলোমেলো হয়ে গেছে । সত্যিই যদি তা-ই হয় কখনও । একটা বই প্রতিবার নতুন করে খোলামাত্র যদি তাকে দেখা যায় নতুন অবয়বে , নতুন আবেদনে , বইয়ের প্রতিটি পুনঃপাঠ তবে পাঠককে দেবে পুনর্জন্ম । একটি সার্থক কবিতার মতো !

পাঠক , রাসেল কথিত নদীর অনুষঙ্গটা মনে পড়ছে কি ?

2 comments:

সুশান্ত কর said...

Ta holei dekho, Oi je loke nak shitek ebole omuker lekha valo tomuker noye seshob koto baje kotha! Ekjoner kache ja valo onyer kache ta mondo hotei pare. Tar jonye ami sobbaike charpotro debar pokkhe. Zodi tar bhasha gyan thake. ami eta ubuntu theke likhchi. tai English Okkhor byabohar korchi.
Ta tomar ki mone hoy amader Pragyan thik jater kagoj noye jekhane lekha deya jay! Na, barak Upotyokar lekhokder emon kichu monobhab ache, tai bollam! Kichutato Obhiman achei!

Shubhajit said...

Chhotobelate j Sukumar Ray pore hashte hashte dom fete jeto aj tar kobita porte gelei one hoy, halka kothay bhadrolok onek kothai bole gechen. Mushkil holo ei shobi i class er bairer pora, porikkhar hall e kon bicharok jante chan ami ki bhabchi? shekhane Derida ba Sontag (banan bhool hote pare) shobar baktobboi 'marginalised', age to pash koro tarpor shunchi. Achha, ami jodi pash na kori tahole amar bhabnagulo ki mithye hobe? Naki 'elite' somaje boshte hole amay 'standard' maintain korte hobe? Ami ajo onek kichu bujhi ni, eta tar ekta.

Majhe majhe bhabi, jodi kono cinema amay kothao kono bhabe chuye jay tahole to she shekhane sharthok. Hote pare tar byakoron bhool kintu tar kothao kono tar amar monke chute to pereche.

যাঁকে ঘিরে আমার অস্তিত্ব ...

যাঁকে ঘিরে আমার অস্তিত্ব ...