অথ বৈধব্য কথা 


উনিশ শতক বাঙালির স্বপ্নদেখার শুরু একটা জুতসই তারিখও উল্লেখ করা যায়, ২০ জানুয়ারি, ১৮১৭ এই তারিখেই স্বপ্ন দেখার আঁতুড়ঘর হিন্দু কলেজের জন্ম যে হিন্দু কলেজের ছাত্রদের সম্পর্কে লর্ড ডালহৌসিকে সতর্ক করে টমাস উড বলেছিলেন : ‘Your Bengalees reading Bacon and Shakespeare – future detractors, opponents and gurmblers.’ ইংরেজদের পাশে বসার মত যোগ্যতা অর্জন করতে পেরে বঙ্গসন্তানদের বুক তখন গর্বে স্ফীত তবে দীর্ঘকালের বন্ধ দরজা খুলল বটে, কিন্তু ভেতর বাড়ির শেকল আঁটা মহলে তখনও হাজার বছরের চাপা অন্ধকার কুসংস্কার লক্ষ্মী তার সাবেকি রাজসিংহাসনে বসে অভিজাত পরিবারের কলাগাছের মত থামওয়ালা বাড়ি থেকে মধ্যবিত্তের সাধারণ ঘরকন্না বা গরিবের নুন আনতে পান্তা ফুরানোর সংসার সবখানেই খুব জাঁকজমকের সংগে রাজত্ব চালাচ্ছেন অর্থনৈতিক বা শৈক্ষিক প্রতিবেশ যাই হোক এক বিশেষ ক্ষেত্রে সেকালের বাঙালি পরিবারের পারিবারিক ইতিহাস অভিন্ন কুলীন অথবা অ-কুলীন, সামাজিক পরিচিতিকে তুচ্ছ করে প্রতি সংসারেই তখন এক বা একাধিক বিধবা নারী সামাজিক অথবা পারিবারিক সবধরণের অধিকার থেকে বঞ্ছিত এই অসহায় বিধবাদের দুঃখগাথা আজ আর কারো অজানা নয় দৈনন্দিন জীবনে এদের লাঞ্ছনা অধীনতা আর অপমান-কথা শুনলে মনে হয় কোনো গল্প উপন্যাসের কাহিনী এই লেখায় সামাজিক ভাবে অত্যাচারিতা অসহায় বিধবাদের কথা যেমন বলার চেষ্টা করেছি তেমনি  সেকালের ব্যতিক্রমী কিছু বিধবাদের কথাও রয়েছে। যারা সংখ্যায় নগন্য হলেও নিজেদের চেষ্টায় অথবা সহৃদয় ব্যক্তিদের আনুকূল্যে নিজেদের অবস্থান থেকে উত্তরণের পথ খুঁজেছিলেন সময়ের নিরিখে তাঁদের এই সাহসী পদক্ষেপ আমাদের আজও রোমাঞ্ছিত করে মূলত উনিশ শতকেরই কিছু জীবনস্মৃতিমুলক রচনা থেকে কাহিনী গুলি সংগৃহীত। পাশাপাশি অন্যান্য বইয়েরও সাহায্য নেওয়া হয়েছে।

       “স্বামীর মৃত্যুর দিন পনের পরেই আমার সেজ দেবর প্রথম আমার উপর অত্যাচার আরম্ভ করেন তেতালার ঘরে যে বড় খাটে আমার স্বামী শুইতেন, ঘরের কপাট ভাঙ্গিয়া সে খাট খানি আমার সেজ দেবর লইয়া গেলেন, আমি কাঁদিলাম জিনিসের লোভে যে আমি কাঁদিলাম তাহা নয়, কাঁদিলাম এই জন্য যে, তিনি যাইতে না যাইতেই ইঁহারা আমার সঙ্গে এইরূপ ব্যবহার করিতে আরম্ভ করিলেন আমার শাশুড়ী মাথা খুঁড়িতে লাগিলেন তাহাতে আমার বড় ভয় ও দুঃখ হইল ভাবিলাম, আমি কেন কাঁদিলাম তাতেই ত তিনি কষ্ট পাইলেন মনকে বলিলাম, তাঁহাদের ভাইয়ের জিনিস তাঁহারা লইবেন, আমি কেন দুঃখ করিব ? আমি ত বাপের বাটী হইতে আনি নাই     
      ঘটনার বিবরণ দিচ্ছেন সারদাসুন্দরী দেবী (যোগেন্দ্রলাল খাস্তগীর অনুলিখিত সারদাসুন্দরীর ‘আত্মকথা’) সম্ভ্রান্ত ঘরের পুত্রবধূ মাত্র নবছর বয়সে কলকাতার বিখ্যাত ধনী দেওয়ান রামকমল সেনের মেজো ছেলে প্যারীমোহন সেনের সঙ্গে তাঁর বিয়ে স্বামীর উৎসাহে কিছুটা লেখাপড়াও শিখেছিলেনসাত সন্তানের জন্মের পর তাঁর উনত্রিশ বছর বয়সে হঠাৎ করেই প্যারীমোহনের মৃত্যুতে সারদাসুন্দরীর জীবনে নেমে আসে দুর্যোগ এই দুর্যোগের শুরুর ঘটনা প্রথমেই উল্লেখ করা হয়েছে স্বামীর খাটের পর তাঁর ব্যবহার করা শালদুটিও নিয়ে যাওয়া হল এবার আর ধৈর্য ধরতে পারেননি সারদা স্বামীর স্মৃতি হিসেবে বারবার শাল দুটি ফেরত পাবার জন্য আর্তি জানালে একটি শাল ফেরত পাওয়া যায় অত্যাচারপর্ব অবশ্য এখানেই শেষ হয়নি সারদাসুন্দরীর সেজো মেয়ে চূণী ছিলেন খুবই সুন্দরী স্বাভাবিকভাবেই এক বিশাল অবস্থাপন্ন ঘরে তাঁর বিয়ে ঠিক  হয় কিন্তু ভাসুর সেই বিয়ে ভেঙে সারদাসুন্দরীর মৃতদার বড় জামাই লক্ষ্মীনারায়ণের সঙ্গে চূণীর বিয়ে দেন এত সম্পদশালী পরিবার কিন্তু বিয়েতে চূণীকে ভাসুর এবং দেবররা একটি কাপড়ও দেননি বলে সারদাসুন্দরীর মনে আজীবন একটা ক্ষোভ ছিল এমনকি তাঁর বিখ্যাত ছেলে ব্রহ্মানন্দ কেশবচন্দ্র সেনের জন্য হাঁড়েলার এক কুলীন পরিবারের পরমাসুন্দরী মেয়ের  সঙ্গে যখন বিয়ের প্রস্তাব আসে তখনও  ভাসুর সেই বিয়ে ভেঙে নিজের সেজ ছেলের সঙ্গে এই মেয়ের বিয়ে দেন আর কেশবচন্দ্রের বিয়ে হয় ভাসুরের পছন্দ করা বালির চন্দ্র মজুমদারের মেয়ে গোলাপসুন্দরীর সঙ্গে এই  প্রসঙ্গে সারদাসুন্দরী বলেছেন, বৌ-এর মুখ দেখিবার পুর্ব্বে আমার মন আরও খারাপ হইল, এমন কি কাঁদিয়া ফেলিলাম কান্নার কারণ আর কিছুই নয়, বিবাহের সময় বৌ অতি ছোট, রোগা ও কাল ছিলেন, মাথার চুল আদপেই ছিল না সম্পত্তি ভাগের সময়ও দেওয়ান রামকমল সেনের পৌত্র প্যারীমোহনের ছেলেরা কিছুই পেলেন না এবারও ভাসুরের মুখে শোনা গেল, তোমাদের ভাগ আমার কাছে রহিল আরও অনেক অত্যাচার অপমান সারদাসুন্দরীকে নীরবে সহ্য করতে হয়েছিল এমনকি কেশবচন্দ্র ব্রাহ্ম ধর্ম গ্রহণ করলে পারিবারিক অত্যাচার মূলত তাঁর উপরেই নেমে আসে কিন্তু এত অত্যাচার সহ্য করেও কোনোদিন তাঁর মনে হয়নি যে কেশব কোনো ভুল কাজ করছেন সেকালে ব্রাহ্ম ছেলের ছোঁওয়া অন্ন মা বাবারা পর্যন্ত স্পর্শ করতে্ন না কখনো ধর্মান্তরিত ছেলে বাড়িতে ফিরে এলে অন্দরমহলে প্রবেশের অধিকার থেকেও সে বঞ্ছিত হত এমনকি বাহির মহলে ভাত খেয়ে তাঁরা নিজেদের উচ্ছিষ্ট নিজেরাই  পরিষ্কার করতেন শিবনাথ শাস্ত্রীর আত্মজীবনী সূত্রে জানা যায় তাঁর বাবা ব্রাহ্ম ছেলেকে হত্যা করার জন্য ভাড়াটে গুণ্ডা পর্যন্ত লাগিয়েছিলেন এমনতর পারিপার্শ্বিক অবস্থায় অন্তঃপুরচারিণী এক মহিলার পক্ষে এই ধর্মীয় সংস্কার আন্দোলনকে মন থেকে মেনে নেওয়া সোজা কথা নয় অভিজাত পরিবারের বিধবা বধূর যদি এই অবস্থা হয়, সাধারণ পরিবারের বিধবাদের অবস্থা সহজেই অনুমেয়।                   
      রসরাজ অমৃতলালের মা মাত্র ছাব্বিশ বছর বয়সেই বিধবা হন দুর্ভাগ্যই বলতে হবে সেই মাসেই হয় তাঁর কলেরা সদ্যবিধবার এই নিদারুণ শারীরিক অসুস্থতায় চিকিৎসার যে বিধান হয় তাঁর প্রত্যক্ষদর্শী ছিলেন অমৃতলাল মায়ের এই কষ্টে স্বাভাবিক ভাবেই পুত্রের প্রাণ কেঁদে উঠে :
                                               নগরে নিদাঘ জৈষ্ঠ দিবা দ্বিপ্রহর    
বিসূচিকা তৃষা তাতে কত ভয়ঙ্কর
শক্তি বুঝিবারে বুঝি সদ্যো বিধবার
সেইদিন একাদশী পড়েছে আবার
         
ভিষক আসিয়া গেল লিখিয়া ঔষধ
একে একাদশী তায়ডাক্তারের মদ
উড়িল ব্যবস্থাপত্র বাতাসে উঠানে,
কাকীমা জলের ফোঁটা দেন মার কানে

পাথরে রাখিয়া জল উদরে বসায়
জননী জীবন পান ঈশ্বর কৃপায়।।

পবিত্র প্রতিমা হেন নাহিক ধরায়
বঙ্গের বিধবা পাশে দেবী হেরে যায়
ভেঙো না প্রতিমা চারু, মুছো না এ ছবি
গলায় কাপড় দিয়ে পায়ে ধরে কবি।।
এই কবিতা যেন সমাজের হয়ে কবিরই পাপস্খলণ সুদক্ষিণা সেন তাঁর ‘জীবনস্মৃতি’তে লিখেছেন, “সে’কালে বিধবাদের নির্জ্জলা একাদশী করিবার নিয়ম ছিল। এই কুসংস্কারটি লোকের মনে এত দৃঢ়বদ্ধ হইয়াছিল যে, একাদশীর দিন কোন বিধবার মৃত্যু হইলেও একবিন্দু জল তাঁহার কণ্ঠ ভিজাইতে পারিতেন না। এমন কি একাদশীর দিনে মৃতা হতভাগিনী বিধবার চিতাভষ্মও ধুইবার নিয়ম ছিল না।”
        এই সুদক্ষিণা সেন শিক্ষানুরাগী অম্বিকাচরণ সেনের স্ত্রীআরও অনেক ব্রাহ্ম মহিলার মত তিনিও আত্মজীবনী লিখেছেন কেশবচন্দ্র প্রতিষ্ঠিত ভারতাশ্রমে কিছুদিন ছিলেন বলে সেই আশ্রমের অনেক কথাও তাঁর আত্মকথা সূত্রে জানা যায় সুদক্ষিণার মা নিত্যকালী ছিলেন খুবই সাহসী এবং বিরল ব্যক্তিত্বের অধিকারী নিত্যকালীর বিয়ে হয় মাইজপাড়া গ্রামের বিখ্যাত কুলীন বংশের সন্তান জগবন্ধু গঙ্গোপাধ্যায়ের সঙ্গে জগদ্বন্ধু কুলীন হলেও কৌলীন্য প্রথাকে ঘৃণাই করতেন। এমনকি ঘটকেরা যখন নিত্যকালীকে বিয়ের পরও প্রতিদিন নতুন নতুন কুলীন কন্যার বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে বাড়িতে আসতেন, তিনি ভয়ে বাড়ি ছেড়ে পালাতেন। এমনকি মাইজপাড়া কুসংস্কারাচ্ছন্ন গ্রাম বলে তিনি স্ত্রীকেও নিজের গ্রামের বাড়িতে খুব কমই নিয়ে গেছেন। বিয়ের পর তাঁর ইচ্ছায় নিত্যকালী লেখাপড়াও শিখেছেন। জগবন্ধুর স্বপ্ন ছিল দুই মেয়েকে শিক্ষিত করে বিয়ের উপযুক্ত বয়স হলেই তাদের বিয়ে দেবেন। কিন্তু স্বপ্ন পূরণের আগেই তাঁর  মৃত্যু হয়। মৃত্যুকালে তিনি স্ত্রীকে বলে যান, “কন্যাদের লেখাপড়া শিখাইও ও বড় করিয়া বিবাহ দিও।” নিত্যকালী সন্তানদের নিয়ে সোহাগদলে পিতৃগৃহেই থেকে গেলেন। জগবন্ধুর ভাইরা মৃত দাদার পরিবারের দায়িত্ব না নিলেও ভাইপো গোবিন্দবন্ধু একটু বড় হতেই কাকারা এসে উপস্থিত  কুলপ্রথা মেনে বংশজ কন্যার সঙ্গে তাঁর বিয়ে  দেবার জন্য। বিধবা ভ্রাতৃবধূকে তারা স্পষ্ট  জানিয়ে দেন যে ‘একটি অকুলীন কন্যার ভার প্রথমে লইতে হইবে। পরে ইচ্ছা করিলে কুলীন কন্যা  বিবাহ করিতে পারিবে।’
    পূর্ববঙ্গের কুলীনদের মধ্যে ‘করণ’ নামে এক বিশেষ প্রথা প্রচলিত ছিলযার অর্থ কুলীন পাত্রের কুল ভঙ্গ করা। এই প্রথা অনুযায়ী পূর্ববঙ্গের অকুলীন ধনী ভূস্বামীরা বংশ মর্যাদা বৃদ্ধির জন্য গরীব কুলীন পাত্রদের সঙ্গে বিশাল অর্থের বিনিময়ে তাঁদের পরিবারের মেয়েদের বিয়ে দিতেন। বিয়ের আগে মেয়ের আত্মীয়রা গুরু ও পুরোহিত সঙ্গে নিয়ে নদী বা পুখুরের মাঝখানে একটি হাঁড়িতে চাল-তিল ইত্যাদি ভরে ভাবি জামাইয়ের কুল অতল জলে ডুবিয়ে আসতেন। এই অনুষ্ঠানই ‘করণ’হাইকোর্টের বিচারপতি আশুতোষ  চৌধুরী, সবুজপত্রের প্রমথ চৌধুরীর দিদি, কবি প্রিয়ংবদা দেবীর মা প্রসন্নময়ীর এই করণ প্রথা মেনেই বিয়ে হয়। প্রসন্নময়ীর আত্মজীবনী সূত্রে জানা যায়, তাঁর চার পিসির মধ্যে তিন পিসির করণ প্রথা মেনে কুলীন বর জুটলেও ছোট পিসি মৃন্ময়ীর জন্য উপযুক্ত কুলীন পাত্র পাওয়া না যাওয়ায় বিপত্নীক বৃদ্ধ পিসেমশাইর সঙ্গেই তাঁর বিয়ে দিয়ে দেওয়া হয়। পুর্ববঙ্গের অর্থলোভী এই কুলীনেরা প্রথমে করণ প্রথা মেনে  কুলমর্যাদাহীন বংশজ ধনী কন্যাকে বিয়ে করার পর যতখুশি কুলীন কন্যা বিয়ে করতেন, কারণ কুলীন পিতারাও যথেষ্ট অর্থ ব্যয় করতেন স্বঘরে কন্যার বিয়ে দেবার জন্য
    নিত্যকালী ভয় পেলেন। পুত্র গোবিন্দবন্ধুর পর পাছে তাঁর মেয়েরা  কুলীন কাকাদের কুসংস্কারের শিকার হয়ে সপত্নী গৃহে যেতে বাধ্য হয় এই ভয়ে তিনি এক দুঃসাহসী কাজ করেন। বাড়ি থেকে পালিয়ে ব্রাহ্মসমাজের আশ্রয় নিয়ে দুই কন্যাকে অসম সাহসিকতার সঙ্গে কুলমর্যাদা অগ্রাহ্য করে বিয়ে দেন বৈদ্য ও কায়স্থ পাত্রের সঙ্গে, যাতে আর কৌলীন্য প্রথার ভয় না থাকে। এই কন্যাদের অন্যতমা সুদক্ষিনা সেন। তাঁর বিয়ে হয় শিক্ষানুরাগী অম্বিকাচরণ সেনের সঙ্গে। সুদক্ষিণা কেশব সেনের নারীবিদ্যালয়ে পড়াশোনা করেছেন। খরচ কমানোর জন্য নিত্যকালী কলকাতা ছেড়ে ঢাকায় চলে এলে তিনি আশ্রয়দাতা পরিবারের সমস্ত রান্না এবং খাবার পরিবেশন শেষ করে ঢাকার ‘এডাল্ট ফিমেল স্কুলে’ পড়তে যেতেন। নিত্যকালী নিজেও বৃত্তি পেয়ে বেথুন স্কুলের ছাত্রী হয়েছিলেন। যদিও শারীরিক অসুস্থতার কারণে তিনদিনের বেশি স্কুলে যেতে পারেননি। সুদক্ষিনা ‘জীবনস্মৃতি’তে মার কথা বলতে গিয়ে লিখেছেন, “যে সময়ে কুসংস্কার ছিল যে মেয়েরা লেখাপড়া শিখিলেই বিধবা হয়, সেই সময় আমার মাতৃদেবী আমাদের লেখাপড়া শিখাইতে চেষ্টা করিয়াছিলেন। তিনি গ্রামের লোকের নিন্দাবাদ গ্রাহ্য করেন নাই।”   
     সুদক্ষিণা সেনের জীবনস্মৃতি সূত্রে আমরা পার্বতী নামে আর এক অসহায় বিধবার কথা জানতে পারি। সুদক্ষিণা তাঁর মামার বাড়ি সোহাগদলেই বড় হয়েছেন। তাঁদের প্রতিবেশী ছিলেন পার্বতী। সুদক্ষিণা তাঁকে পার্বতীমাসি বলে সম্বোধন করতেন। মাত্র আড়াই বছর বয়সে বিয়ে আর পাঁচ বছর বয়সে বিধবা পার্বতীর মড়ার উপর খাঁড়ার ঘায়ের মত ঘরে ছিলেন এক বিমাতা বিমাতার  মাত্রাজ্ঞান কম থাকায় অনেকসময় তার স্নেহের প্রকাশ বিপদসীমাকেও ছাড়িয়ে যেত এ হেন নারকীয় জীবনে পার্বতীর একমাত্র সান্ত্বনার জায়গা ছিল প্রতিবেশী সুদক্ষিণাদের পরিবার সেই পরিবার সূত্রেই ব্রাহ্ম সমাজের সাহসী কর্মকাণ্ডের কথা প্রথম তাঁর কানে আসে এর পর থেকেই স্বপ্ন দেখার শুরু যদি কোনোভাবে একবার ব্রাহ্মসমাজে আশ্রয় পাওয়া যায় তাহলে হয়ত এই নরকতুল্য জীবন থেকে মুক্তি পাওয়া সম্ভব এক্ষেত্রে পার্বতীর ভাগ্যদেবতা তাঁর প্রতি সদয় ছিলেন সুদক্ষিণার সম্পর্কিত মামা  ভগবানচন্দ্র মুখোপাধ্যায় ছিলেন ব্রাহ্ম। তিনি সোহাগদল ঘুরতে এসে পার্বতীর দুঃখের কথা জানতে পেরে প্রতিজ্ঞা করেন, যে ভাবেই হোক পার্বতীকে উদ্ধার করতে হবে এই উদ্দেশ্য নিয়ে নিয়ে তিনি ফিরে গেলেন এবং দুই বন্ধুকে নিয়ে আবার সোহাগদলে এসে গ্রামেরই এক নৌকা ভাড়া করে নদীতীরে গোপনে অপেক্ষা করতে লাগলেন সুদক্ষিণার পরিবার মারফৎ খবর পেয়ে পার্বতী তৈরিই ছিলেন। কিন্তু বিধি বাম, এত করেও শেষ রক্ষা হলনা পার্বতী নৌকায় চড়ামাত্র গ্রামের মাঝিরা তাঁকে চিনে ফেলে এবং গ্রামে খবর পাঠাবার সঙ্গে সঙ্গে তাঁর ভাই বন্ধুরা এসে চড়াও হলেন ভগবানচন্দ্র ও তাঁর সঙ্গীদের উপর সে যাত্রায় উদ্ধারকার্য প্রহারের মাধ্যমেই সম্পন্ন হয় পার্বতীর উপরও অত্যাচারের মাত্রা বাড়ে খেতে বসলে তাঁর খাবার ফেলে থালায় ছাই ঢেলে দেওয়া হত এমনকি তাঁর মাথায় সুন্দর লম্বা চুলকে পরপুরুষের কুদৃষ্টির জন্য দায়ী করে বঁটি দিয়ে সেই চুলও কুরুচিকর ভাবে কেটে ফেলা হয় কিন্তু এত কষ্টেও পার্বতী নীরব ভগবানচন্দ্রও হার মানার পাত্র নন এবার তিনি দূর গ্রাম থেকে নৌকা ভাড়া করে গ্রামের বাজারে এসে বন্ধুদের নিয়ে অপেক্ষা করতে লাগলেন সুদক্ষিণার মামা রাজকুমার মুখোটী বাজার করতে এসে তাঁদের সঙ্গে দেখা হলে তাঁকেই পাঠানো হয় পার্বতীর কাছে তিনি এসে দেখেন পার্বতী ফুল তুলছে তাঁকে সেই অবস্থায়ই নৌকায় তুলে দেওয়া হল পার্বতীর পরিবারের লোকেরা আশেপাশে কোথাও পার্বতীকে খুঁজে না পেয়ে এবং বাগানে ফুলের সাজি পড়ে থাকতে দেখে সন্দেহ করেন যে হয়ত পার্বতীকে বাঘে খেয়েছে অনেকদিন পর অবশ্য তাদের এই ভুল ভাঙে                                                 
      প্রমথ চৌধুরীর দিদি প্রসন্নময়ীও তাঁর ‘পূর্ব্বকথা’য় এক ব্যতিক্রমী শিক্ষিতা বিধবার কথা বলেছেনপ্রসন্নময়ীর ভাষা্তেই গল্পটা শোনা যাক“কাশীশ্বরী সর্বাপেক্ষা পণ্ডিতা, ছোট ছোট বালকবালিকাগণ তাঁহার নিকট লেখাপড়া শিখিতে যাইত। অসহায় বালবিধবার রূপ বড় বিপদজনক, আত্মসম্মান রক্ষার্থে তাঁহাকে অনেক ক্লেশ স্বীকার করিতে হয়। শ্যামাঙ্গিনী কাশীশ্বরী যৌবনে অতিশয় সুরূপা ছিলেন, সুদীর্ঘ কুঞ্চিত কেশ, আয়ত লোচন ও সুঠাম, দীর্ঘ, পূর্ণ দেহ যষ্টি, দর্শকের দৃষ্টি আকর্ষণ করিত, এজন্য তাঁহার একাকিনী পথ ঘাটে চলাফেরা নিরাপদ না থাকায় তিনি কাহাকেও কিছু না বলিয়া এক নিশীথ রাত্রে পুরাতন বৃদ্ধা পরিচারিকা সহ জেলা কোর্টের জজ সাহেবের নিকট আশ্রয় ভিক্ষার আবেদন পত্রসহ যাইয়া উপস্থিত হন, তৎকালে তিন মাস পরে দায়রার বিচারার্থ জজ মহোদয় পাবনা আসিতেন, ইহার মধ্যে অন্যসকল কাজকর্ম রাজসাহীতেই হইত, ব্রহ্মবাদিনী অরুন্ধতীর ন্যায় তেজস্বিনী ব্রাহ্মণ কন্যাকে একাকী বিচারালয়ে দেখিয়া ও তাঁহার বিপন্নাবস্থার কাহিনী শ্রবণে দয়ালু জজ সাহেব এক ‘জরুরি পরোয়ানা’ গ্রামে পাঠাইয়া আজ্ঞা প্রদান করিলেন যে, “এই বিধবা কন্যার প্রতি কখন যদি কোনও রূপ অত্যাচার শুনিতে পান, তাহা হইলে বিনাবিচারে দোষীদিগকে ছয় মাসের জন্য শ্রীঘরে পাঠাইবেন।” জজ সাহেব সরকার হইতে দুঃখিনী বিধবাকে মাসিক পাঁচ টাকা বৃত্তি ধার্য্য করিয়া দিলেন।”
      শুধু সেকালে নয়, বোধ হয় একালেও এই মহিলারা ব্যতিক্রম। এই ব্যতিক্রমী নারীদের সংখ্যা যথেষ্ট না হলেও নিতান্ত কম নয়। সবার কথা হয়ত উল্লেখ করা গেল না। জন্মমুহূর্ত থেকেই নানা সামাজিক প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে ভালো মেয়ে, ভালো বউ বা ভালো মা হওয়ার যে শিক্ষা পুরুষ শাসিত সমাজে  মেয়েদের দেওয়া হয়, সরাসরি সেই প্রক্রিয়াকে অস্বীকার না করে এবং বৌদ্ধিক হাতিয়ারে সমৃদ্ধ না হয়েই সীমিত ক্ষমতায় পারিপার্শ্বিক অবস্থায় মাথা নত না করে মুক্তির যে চেষ্টা এই নারীরা করে গেছেন, সে কথা স্মরণ করে বলতেই হয় যে মূলত এদের হাত ধরেই বঙ্গে নারী জাগরণের সূচনা। অনুমান করতে পারি কাজটি সহজ ছিল না। শিলংপ্রবাসী সাধারণ ব্রাহ্মসমাজের সদস্য শারদামঞ্জরী দত্ত তাঁর আত্মজীবনী ‘মহাযাত্রার পথে’ গ্রন্থে লিখেছিলেন, “ আমার ইচ্ছা করে দেশের দুর্গতি দেখিয়া সর্বদা কাগজপত্রে ঐসব বিষয়ে প্রবন্ধ লিখিতে, বক্তৃতাদি দ্বারা দেশের লোকের মন হইতে ভ্রম ও কুসংস্কার দূর করিতে। কিন্তু সামান্য লেখাপড়া শিখিয়া এ সকল সহজসাধ্য নহে।” সহজ না হলেও তাঁদের চেষ্টাই আজকের মানবীকে স্বাধীনতার ধারণার অবস্থানকে চিহ্নিত করতে সাহায্য করেছে।

মধ্যযুগের বাংলা সাহিত্য : সত্তার সমন্বয়




বাংলা সাহিত্যের মধ্যযুগ সাংস্কৃতিক সমন্বয় ও ধর্মীয় গণচেতনার যুগ। ত্রয়োদশ শতাব্দীর শুরুতেই বাংলাদেশে যে মুসলমান শাসনকাল শুরু হয় তা স্থায়ী হয় প্রায় সাড়ে পাঁচশো বছরবহিরাগত এই শাসন ব্যবস্থা ও ধর্মীয় সামাজিক ক্রিয়াকান্ডের সঙ্গে বাঙালির এই নতুন পরিচয় স্বাভাবিক ভাবেই তার জীবন , সাহিত্য , সংস্কৃতি ও ধর্মচর্চার উপর প্রভাব ফেলেছিল । বিভিন্ন রাজনৈতিক ও সামাজিক কারণে তখন শুরু হয় ধর্মান্তরীকরণ প্রক্রিয়া । যদিও ধর্মান্তরের সংগে সংগেই উত্তরাধিকার সূত্রে লব্ধ হিন্দু ঐতিয্য ও সংস্কারের প্রভাব থেকে এই দেশীয় মুসলমানদের তখনও মুক্তি ঘটেনি । মনে রাখতে হবে তিতুমীরের আবির্ভাব বা ওয়াহাবি আন্দোলন তখনও শুরু হয়নি । এক্ষেত্রে অনেকেই বিদেশি ভাষাজ্ঞানের অভাবকে অন্যতম কারণ হিসেবে উল্লেখ করে থাকলেও সেই যুক্তিও কতখানি গ্রহণযোগ্য তা আলোচনার বিষয় । মূলত শরিয়তী বিধানের প্রতি একটা অবহেলার ভাব তখন ধর্মান্তরিতদের মধ্যে কার্যকরী ছিল ।শাসকবর্গের নানাবিধ প্রচেষ্টাও এই দেশীয় মুসলমান সমাজকে নৈষ্টিক মুসলমানরূপে গড়ে তুলতে পারেনি । এছাড়া আর্থ-সামাজিক দিক দিয়ে একই জায়গায় অবস্থানের ফলে তাদের যৌথ সংস্কৃতিরই দ্বারস্থ হতে হয়েছিল । নবদীক্ষিত মুসলমানেরা যথার্থভা্বে মুসলমান হয়ে উঠতে পারেনি বলেই তাদের আচরিত ধর্মকে একালের অনেক পণ্ডিতেরা লৌকিক ইসলাম বলে আখ্যায়িত করেছেন । বিভিন্ন তথ্যসূত্রে এও জানা যায় যে দেশীয় মুসলমানেরা খোদারসুলের নাম ছেড়ে রামায়ন মহাভারত পাঁচালির আসরে ভীড় জমাতেনউনিশ শতকের প্রথমার্ধে মুসলমান সমাজের ধর্মসংস্কার আন্দোলনের সময় পর্যন্ত বাঙালি মুসলমানেরা হিন্দুদের দুর্গাপূজা, কৃষ্ণ ও শীতলার উপাসনায় অংশগ্রহণ করতেনসন্তান-সন্ততির বিয়ের দিন ধার্য করতে ব্রাহ্মণ পণ্ডিতদের পরামর্শ নেওয়া অথবা শিব-পার্বতী ও লক্ষীকে নিয়ে ধর্ম সংগীত -মনসার ভাসান গান রচনা , নানাবিধ ক্রিয়াকান্ডে হিন্দু সংস্কার পালন এসব কিছুই সেসময়ে নবদীক্ষিত মুসলমানদের মধ্যে প্রচলিত ছিলহিন্দুদের মতোই ভাগ্য গণনা বা শুভকাজে জ্যোতিষির (নাজুমি বা নায়ুমি )শরণাপন্ন হতে সাধারণ থেকে মোগল শাসকদের পর্যন্ত দেখা যায় । ভূতপ্রেতের ভয় এবং এদের প্রভাব থেকে মুক্ত হতে নানাধরণের ডাইনিবিদ্যা ও ইন্দ্রজালের প্রতি আকর্ষণ সেকাল থেকে আজ অব্দি সাধারণ মানুষের মধ্যে বর্তমান । অম্বুবাচীর দিনে হালচাষ বন্ধ রাখা , না-পাক চীজ গোবর দিয়ে অঙ্গন-প্রাঙ্গন পরিষ্কার রাখা, প্রিয়জনের মৃত্যুর পর তিতাভক্ষণ , প্রতীক পূজার প্রভাবে আওরার দিনে হাসান-হোসেনের মূর্তি নির্মাণ করে শ্রদ্ধা নিবেদন হিন্দু প্রভাবে এসব রীতিনীতি মুসলমান সমাজে প্রবলভাবে অনুসৃত হত :
শুনিয়াছি কাফের মুখে কেহ যদি মরে ।
তাহারে দহিয়া যদি ফিরি আইসে ঘরে।।
তিতা ভক্ষি লোহা দেওন্ত ভান্ডে করি সেনান ।
যুগ পদতলে যত্নে রাখন্ত পাষাণ ।।
সে সবের দেখাদেখি মুসলমানগণ
তিতা অন্ন ভক্ষ্য করে কিসের কারণ ।।
** ** **
মৃত ঘরে তিতা অন্ন দিতে অনুচিত ।
মধু মিঠা ঘৃত লনী খাইতে উচিত ।। (শরীয়তনামা : নসরুল্লাহ খোন্দকার)
হিন্দুদের মত মুসলমানরাও বিধবা রমণীকে বিয়ে করতেন না । এমণকি বাগদত্ত পুরুষের মৃত্যু হলে বাগদত্তা নারীকে বিধবা রমণীর নিয়মকানুন পালন করতে হত । কাঁচের চুড়ি , সোণার অলংকার , জমকালো পোশাক পরিধান করা এসব কিছুই এই রমণীদের পক্ষে রীতিবিরুদ্ধ ছিল ।বিয়েতে পণ গ্রহণের রীতি ছিল এবং মৃত্যুর পর স্বামীর পাশে স্ত্রীকে কবর দেওয়া হত । মুসলমান মহিলারা গর্ভে পুত্রসন্তান ধারণের উদ্দেশ্যে হিন্দু নারীর মতই নানা রীতি ও সংস্কার যেমন, মন্ত্রপূত জল ,ঔষধ , কবচ-তাবিচ ইত্যাদি ধারণ করতেন গর্ভাবস্থায় সূর্য বা চন্দ্র গ্রহণের কুপ্রভাবের কথা স্মরণ করে তারা উপবাস পালন করতেনমধ্যযুগের মুসলমানদের এই সাংস্কৃতিক পরিচয় প্রসঙ্গ বিচার করে জগদীশ নারায়ণ সরকার মন্তব্য করেন ,-
বাংলায় মুসলমানরা ইসলামের জন্মস্থান থেকে বিচ্ছিন্ন জীবন যাপন করত । কিন্তু বিজেতাগণ ভিন্ন সংস্কৃতির ধারক বিদেশীদের সঙ্গে ঘনিষ্ট যোগাযোগ রক্ষা করে চলতেন । সংখ্যার দিক দিয়ে ক্ষুদ্র এই জমির পক্ষে অন্য দেশ থেকে অধিবাসীদের আগমণ সত্ত্বেও অগণিত বৈরী জনসাধারণের মোকাবেলা করা সম্ভব ছিল না । বাস্তবতার আলোকে স্থানীয় বিশ্বাস ও প্রথাকে অক্ষুণ্ন রেখে ধর্মান্তরিত করাই সহজ পন্থা হিসেবে বিবেচিত হয়েছিল । এ ধর্মান্তর গ্রহণ অসম্পূর্ণই থেকে যেতো , কারণ সদ্য ধর্মান্তরিতরা নতুন ধর্মের বৈশিষ্ট্য বা কার্যকারণ সম্বন্ধে অজ্ঞ থাকতো এবং নতুন ধর্মীয় নিয়মকানুনগুলো মেনে চলার প্রয়োজনীয়তা উপলব্ধি করতো না । সদ্য ধর্মান্তরিতরা শুধু নামেই মুসলমান ছিল , বিশেষ করে গ্রামাঞ্চলে , যেখানে বু্দ্ধিজীবিদের প্রভাব ছিল ক্ষীণ । যেখানে তারা তাদের অতীত ঐতিয্য , বিশ্বাস , আচার-আচরণ ও পোশাক-পরিচ্ছদে হিন্দু নিয়ম-কানুনই মেনে চলতো । এদের উপর বিদ্বদজনদের প্রভাব ছিল অতি সামান্য । গ্রামে নিম্নবর্ণের ধর্মান্তরিত হিন্দু কারিগরদের মধ্যে পুরাতন ধর্মবিশ্বাস অক্ষুণ্ন থেকে গিয়েছিল ।
(মুগল সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য : জগদীশ নারায়ণ সরকার )
কাজী আবদুল ওদুদ তাঁর শাশ্বত বঙ্গ গ্রন্থে এপ্রসঙ্গে বলেছেন ,- বাংলার কোন কোন সম্ভ্রান্ত মুসলমান দুর্গা-কালী প্রভৃতির পূজা করতেন, একথা সুপ্রসিদ্ধ । এর বড় কারণ বোধহয় এই যে,ওহাবী প্রভাবের পূর্বে মুসলমানদের মানসিক অবস্থা প্রতীক চর্চার একান্ত বিরোধী ছিল না । পীরের কবরে বিশেষ ভক্তি প্রদর্শন , দিন-ক্ষণ পুরোপুরি মেনে চলা ,সমাজে একশ্রেণীর জাতিভেদ স্বীকার করা এসব ব্যাপারে মুসলমানের মনোভাব প্রায় হিন্দুর মতোই ছিল ।
উভয় সম্প্রদায়ের মধ্যে ধর্মীয় বিভেদ সত্ত্বেও একটা সৌহার্দ্যের সম্পর্ক গড়ে ওঠার দরুণ অনেক বাঙালি মুসলমান কবিরা তখন হিন্দুদের ধর্মীয় বিষয় নিয়ে সাহিত্য চর্চা শুরু করেন প্রাক মুগল যুগে সাবিরিদ খাঁ প্রমুখ কবিরা লৌকিক কাহিনীর ছত্র ছায়ায় লৌকিক দেবদেবীর প্রতি হৃদয়ের শ্রদ্ধাই প্রকাশ করেছেন। সাবিরিদ খাঁ তাঁর বিদ্যাসুন্দর কাব্যের সূচনাতেই দেবী কালিকার বন্দনা গান করে স্বরচিত কয়েকটি সংস্কৃত শ্লোক জুড়ে দিয়েছেন । হিন্দুশাস্ত্র ও পুরাণ সম্পর্কে তাঁর গভীর জ্ঞান ও শ্রদ্ধা এই কাহিনীতে প্রকাশ পেয়েছে । এই সমন্বয়ের ক্ষেত্র গড়ে তোলা ও লালন করার ব্যাপারে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য অবদান রেখেছেন সুফিবাদীরা । মানবীয় রূপকে অধ্যাত্ম প্রেমে উপলব্ধি করাই ছিল তাঁদের উদ্দেশ্য । ইউসুফ-জুলেখা , বিদ্যাসুন্দর প্রভৃতি চরিত্রকে কবিরা আধ্যাত্মিক রূপক হিসেবেই গ্রহণ করেছিলেন । ক্রমে পীর কাহিনীকে কেন্দ্র করে হিন্দু-মুসলমান সাংস্কৃতিক ঐতিয্যের একটা ভিত্তিও গড়ে উঠে । বলা যায় পীরপূজা হলো বাঙালি মুসলমান সংস্কৃতির এক অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ । এ প্রসংগে গোলাম মুরশিদ বলেছেন ,-
বাংলার ধর্ম চিরকালই ভক্তিবাদী এবং গুরুমুখী । বাংলাদেশে এই অদ্বৈতবাদী ভক্তিবাদী গুরুমুখী ইসলামই তাই স্ফূর্তি লাভ করেছিল । অদৃশ্য অমূর্ত ঈশ্বরের বদলে দৃশ্যমান পীরই সাধারণ লোকের ভক্তি বেশি আকর্ষণ করেছিলেন । গ্রামবংলার অসংখ্য পীরের মাজার তৈরি হয়েছিলো পীরের প্রতি এই প্রবল ভক্তি থেকে । এসব মাজারে শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে যে পীরপূজা চলেছে , তারও প্রেরণা এই ভক্তিবাদ । ... ইসলাম এবং স্থানীয় ঐতিয্যের ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়ার ফলে পীর দেবতায় পরিণত হন এবং দেবতা পরিণত হন পীরে সত্যপীর যেমন ।
সত্যপীর , মাণিকপীর ,কালু খাঁ গাজী , বড় খাঁ গাজী উভয় সম্প্রদায়ের কাছেই শ্রদ্ধেয় ছিলেনসাধারণ মুসলমানেরা মসজিদে ধর্মীয় প্রার্থনায় অংশগ্রহণ করার চেয়ে এইসব পীরের মোকামে উপাসনা করাকেই বিশেষ পছন্দ করতেন । আবার হিন্দুদের কাছেও এই মোকামগুলি ছিল আকাঙ্খা ও ইচ্ছাপূরণের প্রার্থনাস্থল । মঙ্গলকাব্য তো বটেই , অন্যান্য ছড়া-পাঁচালি-গান ইত্যাদিতেও দেখা যায় অধিকাংশ হিন্দু কবিরাই তাঁদের রচনায় বাংলার পীর ও তাদের ধর্মীয় আশ্রমের কথা উল্লেখ করে বন্দনা গান করেছেন ,-
উত্তরে বন্দনা গো করলাম কৈলাশ পরবত ।
যেখানে পড়িয়া গো আছে আলির মালামের পায়থর ।।
পশ্চিমে বন্দনা গো করলাম মক্কা এন স্থান ।
উড়দিশে বাজায় সেলাম জমিন মুসলমান ।।
সভা বইর‍্যা বইছ ভাইরে হিন্দু-মুসলমান ।
সভার চরণে আমি জানাইলাম সালাম । ।
আসলামে জমিনে বন্দলাম চান্দে আর সুরুয ।
আলাম কালাম বন্দম কিতাব আর কুরাণ ।।
(মহুয়া পালা)
শাসকবর্গের অত্যাচার এড়াতেও হিন্দুরা অনেকসময় পীর বা গাজীর শরণাপন্ন হয়েছেন । মদনের পালাতে দেখা যায় মেদনমল্ল পরগণার হিন্দু জমিদার মদন রায় বাদশাহী কর সময়মত দিতে না পারায় সুবেদার শায়েস্তা খাঁয়ের রোষ নজরে পড়েন । তখন বড় খাঁ গাজী তাঁকে এই বিপদ থেকে উদ্ধার করলে তিনি বিশেষ জাঁকজমকের সংগে গাজীর পূজার ব্যবস্থা করেন । অপরদিকে মির্জাফরের অসুস্থ অবস্থায় দেবী কিরিটেশ্বরীর চরণামৃত পানের কথা অনেক লোককবি উল্লেখ করেছেন । দরবেশ তাহের মামুদ সরকারের শিষ্য কৃষ্ণহরি তাঁর সত্যপীরের পাঁচালিতে ঈশ্বরের স্বরূপ বর্ণনা করেন এই বলে ,-
এক ব্রহ্ম বিনে আর দুই ব্রহ্ম নাই ।
সকলের কর্তা এক নিরঞ্জন গোঁসাই ।।
ব্রহ্মা-বিষ্ণু-মহেশ্বর যার নাম জপে ।
অনন্ত ব্রহ্মাণ্ড যার এক লোমকূপে ।।
যেই নিরঞ্জনের নাম বিসমিল্লা কয় ।
বিষ্ণু আর বিসমিল্লা কিছু ভিন্ন নয় ।।
নাথসাহিত্যে বিখ্যাত কবি শেখ ফয়জুল্লাও গাজীকে ব্রহ্মা-বিষ্ণু-মহেশ্বরের অভিন্ন মূর্তি রূপে কল্পনা করেছেন । স্কন্দপুরাণের রেবাখণ্ডেও সত্যপীর সত্যনারায়ণ নামে জায়গা করে নিয়েছেন এবং সেখানে তার পূজাপদ্ধতির কথাও বর্ণিত হয়েছে । ইসলাম ধর্মের নবী সম্বন্ধে এক মুসলমান গ্রামের মোকাদ্দাম একজন ধর্মপ্রচারককে জানিয়েছিলেন যে,নবীজী এক বাঙালি ব্রাহ্মণ পরিবারে জন্মগ্রহণ করেছিলেন। আবার যোগীরা এই নবীকে গোরখনাথের শিষ্য বলে মনে করতেন ।
( Cencus Report, 1911 ; Encyclopedia of Islam ,11,491 ; D.C.Sen , Chaitanya & His Age )
পাঁচালিকার আব্দুল গফুর কালুগাজী চম্পাবতীতে পাতালে বলির কণ্যাকে গাজীর জননী বলে উল্লেখ করেছেন ।কেতকাদাস ক্ষেমানন্দ তাঁর মনসামঙ্গল কাব্যে মনসার কোপ থেকে বাসর গৃহে লক্ষীন্দরকে বাঁচাতে শৈব চাঁদ সদাগরকে দিয়ে অন্যান্য রক্ষাকবচের সঙ্গে কোরাণও পাঠিয়েছিলেন । একই ঈশ্বরকে হিন্দু-মুসলমানের মধ্যে প্রত্যক্ষ্ করা কিংবা -
হিন্দুর দেবতা হইল মুসলমানের পীর ।
দুই কুলে লয়ে সেবা হইল জাহির ।।
এই সমন্বয় ও সম্প্রীতিই মধ্যযুগের মূল প্রাণের সুর,-
হেঁদু আর মুসলমান একই পিণ্ডের দড়ি ।
কেহ বলে আল্লাহ আর কেহ বলে হরি ।।
বিছমিল্লা আর ছিরিবিষ্টু একই কায়ান ।
দো যাঁকে করি দিয়ে পরভু রাম রহিম ।।
(মলুয়া পালা)
নাথধর্মতত্ত্ব আশ্রয়ে যে সাহিত্যধারা মধ্যযুগে গড়ে ওঠে তার মধ্যে গুরু ও মুর্শিদ বাদের প্রভাব লক্ষ্য করা যায় এধারার অন্যতম কবি শেখ ফয়জুল্লা তাঁর গোরক্ষবিজয় গ্রন্থের সূচনায় ঈশ্বরের বন্দনাগান করে বলেন,-
প্রথমে প্রণাম করি প্রভু করতার ।
নিয়মে সৃজিলা প্রভু সকল সংসার ।।
স্বর্গ মর্ত পাতাল সৃজিলা ত্রিভুবন ।
নানারূপে কেলি করে না জাএ লক্ষণ ।।
তবে প্রণমিয়া তান নিজ অবতার ।
নিজ অংশে করিলেক হইতে প্রচার ।।
শুকুর মাহমুদের গুপিচন্দ্রের সন্ন্যাস কাব্যের বন্দনায়ও একই সুর শোনা যায়,-
প্রথমে বন্দিব আমি নাম নিরঞ্জন ।
যাহাতে হইল ভাই যোগের সৃজন ।।
তবে বন্দিব সিদ্ধা হাড়িফা জলন্ধর ।
যোগ মধ্যে বন্দ সিদ্ধা গোর্খ হরিহর ।।
কানেফা বন্দিব আর বানিজে ভাদাই ।
মছলন্দি সিদ্ধা বন্দ নামেতে মিন্যাই ।।
এখানে মীননাথ হয়ে উঠলেন মছলন্দি পীর । আর ফয়জুল্লা মীননাথের কণ্ঠে অকুণ্ঠ চিত্তে উচ্চারণ করেন ,-
মোর গুরু মহাদেব জগত ঈশ্বর ।
গঙ্গা গৌরী দুই নারী থাকে নিরন্তর ।।
যার দুই নারী তার সাক্ষাতে দিগম্বর ।
হেনরূপে করে গুরু কেলি নিরন্তর ।
তান আছে গৃহবাস আহ্মি কোন হই ।
ভবে মোর একগতি শুন আমি কই ।।
রামায়ণ কাহিনীর জনপ্রিয়তা মুসলমান সমাজে যে কতখানি প্রবল ছিল , রাজসভার পৃষ্টপোশকতার বাইরে অসংখ্য কবির রচনায় তার প্রমাণ রয়েছে । সাদেক আলীর রামচন্দ্রের বনবাস এর এক উল্লেখযোগ্য নিদর্শন । মুহম্মদ খান হিন্দু ধর্মতত্ত্ব নিয়ে রূপকাশ্রয়ে রচনা করেন সত্য কলি বিবাদ সম্বাদকাব্যমধ্যে কলিযুগের লক্ষণ বর্ননা করতে গিয়ে মুহাম্মদ তাঁর চারপাশের বাস্তব জগতের চালচিত্রকেই তুলে ধরেছেন ,-
বৃদ্ধ হৈব নির্লজ্জ বালকে না মানিবে ।
গুরুজন বলি কেহ মান্য না করিবে ।।
সাধু সব কপটে হরিব পর বিত্তি ।
ধনদান না করিব না অর্জিত কীর্ত্তি ।।- ইত্যাদি
অনেক মুসলমান কবি হিন্দু কর্মফলবাদকেও স্বীকার করেছেন।যেমন মর্দনের নছিরনামা য় আছে ,-
দেখ দেখ জার জেই আছে কর্মভোগ ।
সেই মতে কর্মফলে ভুঞ্জে দুঃখ সুখ ।।
হিন্দু যোগতন্ত্রের আশ্রয় গ্রহণ করে সৃষ্টিরহস্য , শূন্যরহস্য ও শূক্ররহস্য প্রভৃতি বিষয়েও বিভিন্ন মুসলমান কবিরা তাঁদের কাব্য রচনা করেছেন । তালিবনামা গ্রন্থে শেখচান্দ বলেন ।-
এ সব রঙ্গের জন্ম ছেহা জন্ম হোতে ।
ভাঙ্গিয়া সকল রঙ্গ মিশিব ছেহাতে ।।
আদ্যেত আছিল প্রভু শূন্যের শরীর ।
ছেয়া রঙ্গে নিজ অঙ্গে হইলেন্ত স্থির ।।
সৃষ্টিতত্ত্বের ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে কবিরা বলেছেন মহম্মদ , নিরঞ্জন আর ব্রহ্মা সকলেরই সৃষ্টি এক উৎস থেকে । ঘর্মসিক্ত নূরের বাম কণ্ঠ থেকে এক বিন্দু ঘাম ঝড়ে পড়ল , আর সেই ঘাম থেকে ,-ব্রহ্মা পয়দা তখন হৈল । ত্রিবেণীর ঘাটে নিত্য স্নান মহাপূণ্যপ্রদ । আব , আতস , বাত প্রভৃতি উপাদান সমূহ এবং ইড়া-পিঙ্গলা প্রভৃতি থাকা সত্ত্বেও প্রাণ দেহ ছেড়ে চলে যায় । কবিদের বিশ্বাস, সাধনার ফলে সিদ্ধিলাভ করতে না পারলে মৃত্যুকে এড়ানো যাবে না । মুসলমান কবিদের এই ধারণার পেছনে হিন্দু মতবাদের পাশাপাশি সুফিতত্ত্ব ও মরমিয়াবাদের প্রভাবটিও প্রবল ছিল । পণ্ডিতদের অনুমান এই যে পারস্যের সুফীধর্মের যোগপদ্ধতি বাংলাদেশে এসে কামরূপের তান্ত্রিক ব্রাহ্মণ ভোজবর্মণ রচিত সংস্কৃত যোগশাস্ত্রের গ্রন্থ অমৃতকুম্ভ দ্বারা প্রভাবান্বিত কুলকুন্ডলিনি শক্তিকে এই সুফীরা লতিফা এবং ষড়দল পদ্মকে বড়লতিফা বলে উল্লেখ করেছেন । সাধনতত্ত্বের বর্ণনায়ও হিন্দু যোগতাত্ত্বিকদের পদানুসরণ করেছেন ,-
ধ্বনি মূলে ব্রহ্ম নাম বায়ুর সঙ্গতি।
সেই নাম পবনে চলএ প্রতিনিতি ।।
সেই ধ্বনি পরমহংস কহে সিদ্ধাগণ ।
হংসনাম তেজেত নির্মল তন মন ।।
* * *
পূরক রেচক সঙ্গে হৃদের কম্পনে ।।
পূরক রেচক সঙ্গে রাখি মহাহংস ।
এক যোগে সাধনে সে শরীর নহে ধ্বংস ।।
এই জ্ঞানমার্গীয় মরমিয়া সুফিবাদ আর চৈতন্যোত্তর সহজিয়া বৈষ্ণব ধর্মই পরবর্তী সময়ে বাউল ধর্মের সুত্রপাত ঘটিয়েছিল।বৈষ্ণব সহজিয়াদের মত বাউলেরাও তাঁদের ধর্মপ্রবর্তক হিসেবে নিত্যানন্দ পুত্র বীরভদ্রের নাম উল্লেখ করে থাকেন । বীরভদ্রের শিক্ষামূলক কড়চা নামে একটি গ্রন্থে বৈষ্ণব ও ইসলাম ধর্মের সমন্বয় সূত্রও নির্দেশ করা হয়েছে । এই গ্রন্থে মহাপ্রভু নিত্যানন্দ তাঁর পুত্রকে মদিনা গিয়ে হজরতের গৃহে মাধববিবির কাছে দীক্ষা গ্রহণ করতে নির্দেশ দিয়েছেন এই বলে ,-
শীঘ্র করে যাহ তুমি মদিনা শহরে ।
যথায় আছেন বিবি হজরতের ঘরে ।।
তথায় যাই শিক্ষা লহ মাধববিবির সনে ।
তাহার শরীরে প্রভু আছেন বর্তমানে ।।
মাধব বিবি বিনে তোর শিক্ষা দিতে নাই ।
তাঁহার শরীরে আছেন চৈতন্য গোঁসাই ।।
হিন্দু ও মুসলমান এই উভয় সম্প্রদায়ের মিলিত সাংস্কৃতিক ঐতিয্যের পরিচয়বাহী অন্যতম সাধনা হল দরবেশ-পীর সাধনা । দরবেশ শাখাভূক্ত তাত্ত্বিক মাধক আলীরাজা হিন্দু তন্ত্র ও যোগশাস্ত্রে অভিজ্ঞতার দরুণ মুসলমানের সংগে সংগে অনেক হিন্দুকেও আকৃষ্ট করেছিলেন । তিনি হিন্দু গুরুবাদের একনিষ্ট ভক্ত ছিলেন । কবি সৈয়দ সুলতানও গুরুর চরণ স্মরণ করে দেহবাদী সাধনায় আত্মমগ্ন হয়ে নানাবিধ পদ রচনা করেছেন । আলীরাজাও একইভাবে গুরুর আরাধনা করেছেন ,-
গুরুর চরণ মূলে থাকি আলীরাজা বলে
রাধা হোন্তে নহে কানু দূরে ।
সৈয়দ সুলতান আক্ষেপ করেন ,-
নামে নহি ব্রাহ্মণ জ্ঞানে নহি পণ্ডিত
ধ্যানে নহি পরম যোগী ।
শুনিয়া গুরুর বানী স্থির নহে মোর প্রাণী
মনে লয় হৈই যাম বৈরাগী ।।
সাধন পথ দ্রষ্টা এই গুরুই যে ইসলামের মুর্শিদ তারই প্রমাণ পাওয়া যায় সেরাজের একটি পদে ,-
কায়াসুদ্ধ্ব হয় জান মুর্সিদ ভজিলে ।
লাঠি লৈক্ষে চলে যেন আন্দিয়াল সকলে ।।
মুর্সিদ প্রসাদে হয় আখিঁর প্রকাশ ।
মিহির কিরণে যেন উজ্জ্বল আকাশ ।।
মুসলমান লোককবিরা যে শুধুমাত্র হিন্দু ও ইসলাম এই উভয় ধর্মের সাম্য সন্ধানেই রত ছিলেন তা নয়, বরং ধর্মত্যাগী হওয়া সত্ত্বেও অনেকক্ষেত্রে ভক্তি ও শ্রদ্ধা সহকারে আদর্শ বৈষ্ণবোচিত গুণাবলী নিয়ে পদসাহিত্য রচনায় মনোনিবেশ করেছিলেন । অমিয় নিমাইর প্রেম ফল্গুধারা তাঁদের চেতনাকে উজ্জীবিত করেছিল । এই বৈষ্ণব ভাবাপন্ন মুসলমান কবিরা বৈষ্ণব ভক্তিবাদ ও মরমিয়া সুফিবাদকে এক করে ফেলেছিলেন । ইসলাম ধর্মে আল্লাহ যেখানে প্রভু, মানুষ সেখানে বান্দা বা দাস । কিন্তু সুফীদের কাছে সৃষ্টিকর্তার সঙ্গে সৃষ্টির সম্পর্ক প্রেমের , প্রভু-ভৃত্যের নয় । তাই মুসলমান কবিরা সহজেই রাধাকৃষ্ণের জীবাত্মা-পরমাত্মা ভাব স্বরূপকে আশেক-মাশুকের সঙ্গে একাকার করে নিয়েছিলেন । অনেকসময় তাঁরা তাঁদের ধর্মীয় প্রবক্তাদেরও শ্রী কৃষ্ণের মধ্যে উপলব্ধি করেছিলেন । বদিউজ্জামাল তাই অকপটে বলেন ,-
সবে বলে কালারে কালা আমি বলি শ্যাম ।
কালার ভিতরে লুকাই রে রইছে মওলার নিজ নাম ।
আসমান কালা জমিন রে কালা কালা পবন পানি ।
চাঁদ কালা সূর্যরে কালা , কালা মাওলাজি রব্বানি ।।
সুফীপ্রভাবে মুসলমান কবিরা ঈশ্বরকে রাধা বলে সম্বোধন করতে চাইলেও অনেকসময় মৌলবীদের চোখরাঙানো এতে বাধা হয়ে দাঁড়াত , সেই বাস্তব ছবিটি ধরা পড়েছে বামন উদাসের পদে ,-
হিন্দুরা বলে তোমায় রাধা , আমি বলি খোদা রাধা বলিয়া ডাকিলে মুল্লামুন্সিতে দেয় বাধা ।।
বৈষ্ণবীয় স্বকীয়া-পরকীয়া তত্ত্বও তাদের অগোচর ছিলনা ,-
স্বকীয়ার সঙ্গে নহে অতি প্রেমরস ।
পরকীয়া সঙ্গে যোগ্য প্রেমের মানস ।।
এই কবিরা রাধাকৃষ্ণের অনুরাগ এবং বিশ্বের স্বরূপ বর্ণনার মাধ্যমে একেশ্বরবাদেরও প্রচার করেছেন,- এক কায়া এক ছায়া নাহিক দোসর ।
এক তন এক মন আছে একেশ্বর ।।
ত্রিজগত এক কায়া এক করতার
এক প্রিভু সেবে জপে সব জীবধর ।।
বৈষ্ণব সহজিয়ারা যাকে পরমপুরষ বলেছেন , বাউলদের কাছে তিনিই হলেন সাঁই , আর মুসলমান বাউলদের কাছে তিনিই হলেন আলেখ নূরফকির সাধক সৈয়দ মর্তুজা মুসলমান বাউল হয়েও হিন্দুরই মতো পরমপুরুষকে সাঁই বলে সম্বোধন করে তাঁর সংগে ব্রহ্মা-বিষ্ণু-মহেশ্বরের অভিন্নতার কথা উল্লেখ করেছেন ,- সাঁই একবিনে মাওলা একবিনে আর নাহি কোই।
আরেক সমন্বয়বাদী কবি মহম্মদও বৈষ্ণব ধর্মের হ্লাদিনী শক্তির স্বরূপ অনায়াসে ব্যক্ত করেন,-
আল্লা মহম্মদ রাধাকৃষ্ণ একাঙ্গ একাত্মা যার।
এক হাতে বাজে না তালি এক সুরের কথা বলি
নীরে ক্ষীরে চলাচলি বীজের এই বিচার ।
পিতা আল্লা মাতা আহ্লাদিনী মর্ম বোঝা হল ভার ।।
মুসলমান কবিদের সাহিত্য ও সংস্কৃতি চর্চায় সম্প্রীতি গড়ে তোলার যে প্রয়াস দেখা যায় তা সেকালে হিন্দু কবিদেরও ইসলাম বিষয়ক কাব্য , কবিতা ও সঙ্গীত রচনায় উৎসাহিত করেছিল । যদিও এই প্রয়াসের চেষ্টা সীমিতই ছিল । প্রথাগত সাহিত্যচর্চা থেকে বেরিয়ে আসতে দেরী হলেও কিছু হিন্দু কবি-সাহিত্যিক নতুন যাত্রাপথের উদ্দেশ্যে পাড়ি জমাতে সমর্থ হয়েছিলেন এবং বাংলা সাহিত্যের আঙিনায় রাধাচরণ , মানিকদাস প্রমুখ কবিদের আবির্ভাব ঘটে । ধর্মীয় সংকীর্ণতার বন্ধন ছিন্ন করে মাণিকদাস আল্লার কাছে করুণা ভিক্ষা করে বলেন ,- আল্লা অন্তকালে কি বোল বুলিম নিজ ঘরে গিয়া কি হৈল কি হৈল মোরে দিয়া ।।
জেতের ফাতা বিকিয়েছে সাত বাজারে লালনের এই গানেও জাতিবর্ণভেদের উর্ধ্বে উদার মানবিকতা বোধের যে পরিচয় আমরা পাই সেই মানবধর্ম প্রচারই ছিল সেযুগের কাব্যসাহিত্য সাধনার এক বিশেষ আন্তরধর্ম । এই ধারাকেই আজও লালন করে চলেছে সাধারণ গ্রামীণ মানুষ তাদের হৃদয়ে ও ভাবপ্রকাশে । বিপন্ন সময় আর প্রতিকূল সংকটের মধ্যে এই পথই হল মুক্তির পথ । মধ্যযুগের কবিরা দ্বন্দ্ব-সংকটের মধ্যেও এই মানব প্রীতি ও ঐক্যবোধের সাধনার ধারাটিকেই প্রশস্ত করে তুলেছিলেন
·

যাঁকে ঘিরে আমার অস্তিত্ব ...

যাঁকে ঘিরে আমার অস্তিত্ব ...