কবিতার জন্ম : কবির জন্মান্তর



"যখন বিষন্ন তাপে প্রধূম গোধূলি তার করুণাবসন ফেলে সূর্যমুখী পৃথিবীকে ঢাকে
কঠিন বিলাপে কাঁপে উপশিরা-শিরা , জ্যোতিষ্কলোকের রূপসীরা একে একে
ছিন্ন করে দয়িত-আকাশ , যখন প্রেমের সত্য ভুবনে ভুবনে ফেরে করুণ লেখায় ,
তুমিও আসন্ন চন্দ্রে মেলে দাও হৃদয় তোমার , আমি থরোথরো শীতে যন্ত্রনার
শিখা মেলি আতপ-তির্যক , যখন পৃথিবী কাঁপে মৃততেজা মুঠোতে আমার --

তখন কবিতা মিতা , প্রিয় থেকে প্রিয় সখী , সুহৃদ , সুন্দর ।"

-- ১১ জানুয়ারি । দুপুর : শঙ্খ ঘোষ ।



প্যারিসের এক হোটেল । পিকাসো দাঁড়িয়ে আয়নার সামনে । দাড়ি কামাচ্ছিলেন । আপোলিনেয়ারের মৃত্যুসংবাদ তখনই কানে এল । এক-দিগন্ত যন্ত্রনায় ভেঙ্গে গেল হৃদয় । সেইসঙ্গে মুখটাও । শূন্য দৃষ্টি আয়নায় পড়তেই চমকে উঠলেন শিল্পী । এ কার মুখ ? রেজার রেখে হাতে তুলে নিলেন কাগজ-পেনসিল । ব্যথিত হৃদয়-আর্তি আয়নায় প্রতিফলিত সেই দুমড়ে-মুচড়ে যাওয়া মুখচ্ছবিকে ক্যানভাসে রূপ দিতে লাগল । আত্মার আলোড়িত আবেগ জন্ম দিল এক যুগান্তকারী অমর সৃষ্টির । আত্মিক যন্ত্রনার এই শিল্পিত উত্তরণ শিল্পীকে দিল আবেগিক মুক্তি । কিউবিক রীতির এই আত্মপ্রতিকৃতি দ্বারা পিকাসো বন্ধুর মৃত্যুকে জানালেন বিনম্র শ্রদ্ধা । আর এই সৃষ্টির সূত্র ধরেই শিল্পীজীবনেও ঘটল জন্মান্তর -- 'এ ফেয়ারওয়েল টু ইয়ুথ ' । যৌবনের কল্পলোককে বিদায় জানিয়ে শিল্পী পা দিলেন প্রৌঢ়ত্বের শক্ত মাটিতে ।

জীবনে যা সত্য , শিল্প সেই সত্যেরই সংহত ও সুন্দর প্রতিভাস । কবিতাও এই সত্যের সারবস্তুকে গ্রহণ করে শোভন হয়ে উঠে এবং শিল্পিত উৎকর্ষতা লাভ করে । আত্মসত্তার সুখ-আহ্লাদ ,হর্ষ-পুলক , দুঃখ-যন্ত্রনা , আবেগ-দরদ , ব্যাথা-মনস্তাপ অনুভূতিশীল কবিকে সৃষ্টির এক প্রদীপ্ত উৎসের পথে চালিত করে । যতক্ষণ না কবিমননে আলোড়িত ভাবনার মুক্তি ঘটে ততক্ষণ কবিরও রেহাই নেই । প্রকাশের অবর্ণনীয় আনন্দ কবিকে দেয় প্রজাপতির সৃষ্টির স্বাদ । মনন-প্রতিচ্ছায়া সৃষ্টির এই প্রয়াস জন্মান্তরের এক অনন্য উপলব্ধি । কিন্তু কবিহৃদয় শুধু তৃপ্ত হয় না । সৃষ্টির স্বরূপ উদ্ভাসেও তিনি সমান যত্নবান । ' মা নিষাদ প্রতিষ্টাং ' উচ্চারণেই আদিকবির ক্রৌঞ্চবিরহের শোকাবেগ পরিতৃপ্তি লাভ করেনা । এরপরেও তাঁকে এই পাদবন্ধের স্বরূপ সম্পর্কে ভাবতে হয় । এভাবেই জন্ম হয় ' শ্লোক '-এর --শোকার্ত হৃদয়-আর্তির । শ্লোক ছন্দের তন্ত্রীতে আন্দোলিত কবিতারই প্রাচীন নাম । কবিমানসের পক্ষে ভাবযন্ত্রনা উপেক্ষা করা অসম্ভব । প্রকাশের যন্ত্রনাই তাঁর জীবনে আনে প্রকাশের অসীম আনন্দ -- দান করে মুক্তি । কাব্য সৃষ্টি লগ্নের এই যন্ত্রনা ' রক্তকে কালিতে রূপান্তরের যন্ত্রনা ' । এই যন্ত্রনার জন্ম আত্মার অতল গভীরে -- মরমী আবেগে । আত্মাভিমানের খোঁজে সৃষ্টির মহত্বে । শব্দ, চিন্তা আর বাক্যের অস্থি নিয়ে কবির আবেগ থেকে ভূমিষ্ট হয় কাব্যশরীর । তার থাকেনা কোনো ব্যাক্তিপরিচয় । নিজের অস্তিত্ত্বের উর্ধ্বে সর্বজনীনপরিচয়ই এর লক্ষ্য । কবিতার এই সার্বিক ব্যঞ্জনা সেই মহাকাব্যের যুগ থেকে কবিকে দিয়ে এসেছে নবজাতের সম্মান ।

কবির কাছে কবিতা ' সমস্ত জ্ঞানের শ্বাসপ্রশ্বাস আর সুক্ষ আত্মা ' । এই সুক্ষ আত্মার অবাধ সঞ্চরণেই কবিতা ঋদ্ধ হয়ে উঠে । এর অবারিত যাত্রা কবিকে এই বোধে পৌঁছে দেয় যে ' আমার জন্মের কোনো শেষ নেই ' । প্রতিটি নতুন কবিতার জন্ম কবিকে দেয় জন্মান্তরের আস্বাদ । এই আস্বাদ কবি অনুভূতির কাছে দাবী রাখে ' যেতে যেতে মনে রেখো পিছনে কী ছিল '। ভূত বর্তমান ভবিষ্যত ' প্রতিমুহূর্ত বাড়িয়ে দেয় হাত / সম্পর্কে আনন্দে দূর্বাজলে '।
কবির কাছে জীবনও ' দাবি করেছিল যেন প্রত্যেক মুহূর্তে তুমি কবি '। প্রত্যেক মুহূর্তে কবি হয়ে ওঠার দায়িত্ব কবিরা অস্বীকার করেন না । তাঁর ' না লেখা কবিতাগুলি' সবসময় তাঁকে ' সর্বাঙ্গ জড়িয়ে আদর করে ,চলে যায় ঘুরে ফিরে আসে ' । তিনি অনুভব করেন ' কবিতা লেখার চেয়ে কবিতা লিখবো লিখবো এই ভাবনা আরও প্রিয় লাগে ' । চোখে ' কবিতার সুখস্বপ্ন গাঢ় হয়ে আসে ' । তখন মেধা এসে ডেকে নিয়ে যায় কবিকে । কবিমুখে উচ্চারিত হয় সেই ধ্রুব স্বীকারোক্তি :

" কবিতার সত্যে আমি একঝলক মিথ্যের বাতাস
লাগাই , কী পালটে যায় কবিতার সত্য একদিনে
তাহলে সত্যের নেই সেই বুঝ , সেই দাঁড়সাঁতার ,
সত্য নয় শিশু , নয় রাজনীতি , নয় মুথা ঘাস । "

এই ' মিথ্যের বাতাস ' কবির রৌদ্র রূপালি হৃদয়ে প্রশ্ন রাখে ' কবিতার সার কথা নাকি সত্য , অথচ কবিরা সব মিথ্যুকের একশেষ নয়?' কবি সমাজের আত্মা নন । তিনি সেই ' sooth sayer ' এর ভূমিকাও পালন করেন না যে জুলিয়াস সিজারকে বলেছিল তাঁর দিন ফুরিয়ে এসেছে । কবির সত্য সমাজের দিগদর্শনের জন্যও সৃষ্টি হয় না। বাস্তবকে তিনি গ্রহণ করেন নিজের মত করে । কবি জানেন কবিতার আবেদন বুদ্ধি মেধা বা জ্ঞানের কাছে নয় -- এর আবেদন হৃদয়ের গহীনে । জীবনের মানুষের সংসারের প্রকৃতিজাত সারসত্যকে তিনি উদ্ভাসিত করে তোলেন তার একান্ত নিজস্ব বিশ্বাসের আলোকে । কবির বিশ্বাস বাস্তব সবসময় সত্যকে অনুসরণ নাও করতে পারে । ' কবিরা সবসময় সত্যদ্রষ্টা হয় না ' -- এই স্বীকারোক্তিকে সামনে রেখেই সুক্ষ্ম আত্মার বিচরণের অভিজ্ঞতায় কবি কাব্যসত্যকে রচনা করেন । তাঁর একটাই আশা , ' শব্দ তার প্রতিবিম্ব আমাকে দেখাবে বলেছিল '। এই প্রত্যয় নিয়েই চলে কবিতার সঙ্গে কবির নিত্য ঘরকন্না , জন্ম হয় নতুন নতুন কবিতার । এই প্রতিটি নতুন কবিতার মধ্যে অর্ন্তলীন থেকে যায় একটাই সত্য -- কবি যাকে খোঁজেন সারাজীবন ধরে । জন্ম হয় নতুন নতুন কবিতার । কবিমন উপলব্ধি করে :

' একটাই তো কবিতা
লিখতে হবে , লিখে যাচ্ছি সারা জীবন ধরে । '

আজীবন এই একটা কবিতার অনুশীলন করেই কবির পথচলা । এই পথচলা জীবনসত্যে উত্তরণের জন্য । এই সত্য কবিজীবনে এনে দেয় অলৌকিক আস্বাদ । সৃষ্টির অতৃপ্তি থেকে সৃষ্ট হয় প্রতিটি নতুন কবিতার । বাস্তব পরিপার্শ্ব তাঁর হৃদয়ে জাগায় তীব্র আলোড়ন । অন্য সব মানসিক কষ্ট থেকেও এই যন্ত্রনা দুঃসহ হয়ে উঠে । মননের আয়ু ঝড়িয়ে যতক্ষন না এই কষ্টকে কবি হৃদয় করতে নিংড়ে প্রকাশ করতে পারেন ততক্ষন তা কবিকে কুরে কুরে খায় । কিন্তু একবার তা কবিতাকারে প্রকাশ হয়ে যাবার পর এক অনিবর্চনীয় আনন্দ্রসে ডুবে যায় কবিমন । আত্মিক যন্ত্রনার পরিণাম এই সৃষ্টি কবিকে দেয় এক অনন্য অনুভূতি । যন্ত্রনার এই জন্মান্তরের আস্বাদ থেকেই কবি বারবার আশ্রয় খোঁজেন কবিতার ওমে । সৃষ্টির এই আতৃপ্তি কখনও পূর্ণ হবার নয় । অতৃপ্ত এই অনুভূতির অভাবে মৃত্যু ঘটে সৃষ্টির -- মৃত্যু হয় কবির । জীবনের আকাঙ্খায় কবিকে কবিতা সৃষ্টি করটি হয় । এভাবেই জন্ম হতে থাকে কবিতার -- কবির ঘটতে থাকে জন্মান্তর ।


( এই আলোচনায় ওয়ার্ডসওয়ার্থ , এলিয়ট , শক্তি চট্টোপাধ্যায় , শঙ্খ ঘোষ , সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় এবং জয় গোস্বামীর কবিতার অংশবিশেষ ব্যবহৃত হয়েছে । )

No comments:

যাঁকে ঘিরে আমার অস্তিত্ব ...

যাঁকে ঘিরে আমার অস্তিত্ব ...