মধ্যযুগের বাংলা সাহিত্য : সত্তার সমন্বয়




বাংলা সাহিত্যের মধ্যযুগ সাংস্কৃতিক সমন্বয় ও ধর্মীয় গণচেতনার যুগ। ত্রয়োদশ শতাব্দীর শুরুতেই বাংলাদেশে যে মুসলমান শাসনকাল শুরু হয় তা স্থায়ী হয় প্রায় সাড়ে পাঁচশো বছরবহিরাগত এই শাসন ব্যবস্থা ও ধর্মীয় সামাজিক ক্রিয়াকান্ডের সঙ্গে বাঙালির এই নতুন পরিচয় স্বাভাবিক ভাবেই তার জীবন , সাহিত্য , সংস্কৃতি ও ধর্মচর্চার উপর প্রভাব ফেলেছিল । বিভিন্ন রাজনৈতিক ও সামাজিক কারণে তখন শুরু হয় ধর্মান্তরীকরণ প্রক্রিয়া । যদিও ধর্মান্তরের সংগে সংগেই উত্তরাধিকার সূত্রে লব্ধ হিন্দু ঐতিয্য ও সংস্কারের প্রভাব থেকে এই দেশীয় মুসলমানদের তখনও মুক্তি ঘটেনি । মনে রাখতে হবে তিতুমীরের আবির্ভাব বা ওয়াহাবি আন্দোলন তখনও শুরু হয়নি । এক্ষেত্রে অনেকেই বিদেশি ভাষাজ্ঞানের অভাবকে অন্যতম কারণ হিসেবে উল্লেখ করে থাকলেও সেই যুক্তিও কতখানি গ্রহণযোগ্য তা আলোচনার বিষয় । মূলত শরিয়তী বিধানের প্রতি একটা অবহেলার ভাব তখন ধর্মান্তরিতদের মধ্যে কার্যকরী ছিল ।শাসকবর্গের নানাবিধ প্রচেষ্টাও এই দেশীয় মুসলমান সমাজকে নৈষ্টিক মুসলমানরূপে গড়ে তুলতে পারেনি । এছাড়া আর্থ-সামাজিক দিক দিয়ে একই জায়গায় অবস্থানের ফলে তাদের যৌথ সংস্কৃতিরই দ্বারস্থ হতে হয়েছিল । নবদীক্ষিত মুসলমানেরা যথার্থভা্বে মুসলমান হয়ে উঠতে পারেনি বলেই তাদের আচরিত ধর্মকে একালের অনেক পণ্ডিতেরা লৌকিক ইসলাম বলে আখ্যায়িত করেছেন । বিভিন্ন তথ্যসূত্রে এও জানা যায় যে দেশীয় মুসলমানেরা খোদারসুলের নাম ছেড়ে রামায়ন মহাভারত পাঁচালির আসরে ভীড় জমাতেনউনিশ শতকের প্রথমার্ধে মুসলমান সমাজের ধর্মসংস্কার আন্দোলনের সময় পর্যন্ত বাঙালি মুসলমানেরা হিন্দুদের দুর্গাপূজা, কৃষ্ণ ও শীতলার উপাসনায় অংশগ্রহণ করতেনসন্তান-সন্ততির বিয়ের দিন ধার্য করতে ব্রাহ্মণ পণ্ডিতদের পরামর্শ নেওয়া অথবা শিব-পার্বতী ও লক্ষীকে নিয়ে ধর্ম সংগীত -মনসার ভাসান গান রচনা , নানাবিধ ক্রিয়াকান্ডে হিন্দু সংস্কার পালন এসব কিছুই সেসময়ে নবদীক্ষিত মুসলমানদের মধ্যে প্রচলিত ছিলহিন্দুদের মতোই ভাগ্য গণনা বা শুভকাজে জ্যোতিষির (নাজুমি বা নায়ুমি )শরণাপন্ন হতে সাধারণ থেকে মোগল শাসকদের পর্যন্ত দেখা যায় । ভূতপ্রেতের ভয় এবং এদের প্রভাব থেকে মুক্ত হতে নানাধরণের ডাইনিবিদ্যা ও ইন্দ্রজালের প্রতি আকর্ষণ সেকাল থেকে আজ অব্দি সাধারণ মানুষের মধ্যে বর্তমান । অম্বুবাচীর দিনে হালচাষ বন্ধ রাখা , না-পাক চীজ গোবর দিয়ে অঙ্গন-প্রাঙ্গন পরিষ্কার রাখা, প্রিয়জনের মৃত্যুর পর তিতাভক্ষণ , প্রতীক পূজার প্রভাবে আওরার দিনে হাসান-হোসেনের মূর্তি নির্মাণ করে শ্রদ্ধা নিবেদন হিন্দু প্রভাবে এসব রীতিনীতি মুসলমান সমাজে প্রবলভাবে অনুসৃত হত :
শুনিয়াছি কাফের মুখে কেহ যদি মরে ।
তাহারে দহিয়া যদি ফিরি আইসে ঘরে।।
তিতা ভক্ষি লোহা দেওন্ত ভান্ডে করি সেনান ।
যুগ পদতলে যত্নে রাখন্ত পাষাণ ।।
সে সবের দেখাদেখি মুসলমানগণ
তিতা অন্ন ভক্ষ্য করে কিসের কারণ ।।
** ** **
মৃত ঘরে তিতা অন্ন দিতে অনুচিত ।
মধু মিঠা ঘৃত লনী খাইতে উচিত ।। (শরীয়তনামা : নসরুল্লাহ খোন্দকার)
হিন্দুদের মত মুসলমানরাও বিধবা রমণীকে বিয়ে করতেন না । এমণকি বাগদত্ত পুরুষের মৃত্যু হলে বাগদত্তা নারীকে বিধবা রমণীর নিয়মকানুন পালন করতে হত । কাঁচের চুড়ি , সোণার অলংকার , জমকালো পোশাক পরিধান করা এসব কিছুই এই রমণীদের পক্ষে রীতিবিরুদ্ধ ছিল ।বিয়েতে পণ গ্রহণের রীতি ছিল এবং মৃত্যুর পর স্বামীর পাশে স্ত্রীকে কবর দেওয়া হত । মুসলমান মহিলারা গর্ভে পুত্রসন্তান ধারণের উদ্দেশ্যে হিন্দু নারীর মতই নানা রীতি ও সংস্কার যেমন, মন্ত্রপূত জল ,ঔষধ , কবচ-তাবিচ ইত্যাদি ধারণ করতেন গর্ভাবস্থায় সূর্য বা চন্দ্র গ্রহণের কুপ্রভাবের কথা স্মরণ করে তারা উপবাস পালন করতেনমধ্যযুগের মুসলমানদের এই সাংস্কৃতিক পরিচয় প্রসঙ্গ বিচার করে জগদীশ নারায়ণ সরকার মন্তব্য করেন ,-
বাংলায় মুসলমানরা ইসলামের জন্মস্থান থেকে বিচ্ছিন্ন জীবন যাপন করত । কিন্তু বিজেতাগণ ভিন্ন সংস্কৃতির ধারক বিদেশীদের সঙ্গে ঘনিষ্ট যোগাযোগ রক্ষা করে চলতেন । সংখ্যার দিক দিয়ে ক্ষুদ্র এই জমির পক্ষে অন্য দেশ থেকে অধিবাসীদের আগমণ সত্ত্বেও অগণিত বৈরী জনসাধারণের মোকাবেলা করা সম্ভব ছিল না । বাস্তবতার আলোকে স্থানীয় বিশ্বাস ও প্রথাকে অক্ষুণ্ন রেখে ধর্মান্তরিত করাই সহজ পন্থা হিসেবে বিবেচিত হয়েছিল । এ ধর্মান্তর গ্রহণ অসম্পূর্ণই থেকে যেতো , কারণ সদ্য ধর্মান্তরিতরা নতুন ধর্মের বৈশিষ্ট্য বা কার্যকারণ সম্বন্ধে অজ্ঞ থাকতো এবং নতুন ধর্মীয় নিয়মকানুনগুলো মেনে চলার প্রয়োজনীয়তা উপলব্ধি করতো না । সদ্য ধর্মান্তরিতরা শুধু নামেই মুসলমান ছিল , বিশেষ করে গ্রামাঞ্চলে , যেখানে বু্দ্ধিজীবিদের প্রভাব ছিল ক্ষীণ । যেখানে তারা তাদের অতীত ঐতিয্য , বিশ্বাস , আচার-আচরণ ও পোশাক-পরিচ্ছদে হিন্দু নিয়ম-কানুনই মেনে চলতো । এদের উপর বিদ্বদজনদের প্রভাব ছিল অতি সামান্য । গ্রামে নিম্নবর্ণের ধর্মান্তরিত হিন্দু কারিগরদের মধ্যে পুরাতন ধর্মবিশ্বাস অক্ষুণ্ন থেকে গিয়েছিল ।
(মুগল সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য : জগদীশ নারায়ণ সরকার )
কাজী আবদুল ওদুদ তাঁর শাশ্বত বঙ্গ গ্রন্থে এপ্রসঙ্গে বলেছেন ,- বাংলার কোন কোন সম্ভ্রান্ত মুসলমান দুর্গা-কালী প্রভৃতির পূজা করতেন, একথা সুপ্রসিদ্ধ । এর বড় কারণ বোধহয় এই যে,ওহাবী প্রভাবের পূর্বে মুসলমানদের মানসিক অবস্থা প্রতীক চর্চার একান্ত বিরোধী ছিল না । পীরের কবরে বিশেষ ভক্তি প্রদর্শন , দিন-ক্ষণ পুরোপুরি মেনে চলা ,সমাজে একশ্রেণীর জাতিভেদ স্বীকার করা এসব ব্যাপারে মুসলমানের মনোভাব প্রায় হিন্দুর মতোই ছিল ।
উভয় সম্প্রদায়ের মধ্যে ধর্মীয় বিভেদ সত্ত্বেও একটা সৌহার্দ্যের সম্পর্ক গড়ে ওঠার দরুণ অনেক বাঙালি মুসলমান কবিরা তখন হিন্দুদের ধর্মীয় বিষয় নিয়ে সাহিত্য চর্চা শুরু করেন প্রাক মুগল যুগে সাবিরিদ খাঁ প্রমুখ কবিরা লৌকিক কাহিনীর ছত্র ছায়ায় লৌকিক দেবদেবীর প্রতি হৃদয়ের শ্রদ্ধাই প্রকাশ করেছেন। সাবিরিদ খাঁ তাঁর বিদ্যাসুন্দর কাব্যের সূচনাতেই দেবী কালিকার বন্দনা গান করে স্বরচিত কয়েকটি সংস্কৃত শ্লোক জুড়ে দিয়েছেন । হিন্দুশাস্ত্র ও পুরাণ সম্পর্কে তাঁর গভীর জ্ঞান ও শ্রদ্ধা এই কাহিনীতে প্রকাশ পেয়েছে । এই সমন্বয়ের ক্ষেত্র গড়ে তোলা ও লালন করার ব্যাপারে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য অবদান রেখেছেন সুফিবাদীরা । মানবীয় রূপকে অধ্যাত্ম প্রেমে উপলব্ধি করাই ছিল তাঁদের উদ্দেশ্য । ইউসুফ-জুলেখা , বিদ্যাসুন্দর প্রভৃতি চরিত্রকে কবিরা আধ্যাত্মিক রূপক হিসেবেই গ্রহণ করেছিলেন । ক্রমে পীর কাহিনীকে কেন্দ্র করে হিন্দু-মুসলমান সাংস্কৃতিক ঐতিয্যের একটা ভিত্তিও গড়ে উঠে । বলা যায় পীরপূজা হলো বাঙালি মুসলমান সংস্কৃতির এক অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ । এ প্রসংগে গোলাম মুরশিদ বলেছেন ,-
বাংলার ধর্ম চিরকালই ভক্তিবাদী এবং গুরুমুখী । বাংলাদেশে এই অদ্বৈতবাদী ভক্তিবাদী গুরুমুখী ইসলামই তাই স্ফূর্তি লাভ করেছিল । অদৃশ্য অমূর্ত ঈশ্বরের বদলে দৃশ্যমান পীরই সাধারণ লোকের ভক্তি বেশি আকর্ষণ করেছিলেন । গ্রামবংলার অসংখ্য পীরের মাজার তৈরি হয়েছিলো পীরের প্রতি এই প্রবল ভক্তি থেকে । এসব মাজারে শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে যে পীরপূজা চলেছে , তারও প্রেরণা এই ভক্তিবাদ । ... ইসলাম এবং স্থানীয় ঐতিয্যের ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়ার ফলে পীর দেবতায় পরিণত হন এবং দেবতা পরিণত হন পীরে সত্যপীর যেমন ।
সত্যপীর , মাণিকপীর ,কালু খাঁ গাজী , বড় খাঁ গাজী উভয় সম্প্রদায়ের কাছেই শ্রদ্ধেয় ছিলেনসাধারণ মুসলমানেরা মসজিদে ধর্মীয় প্রার্থনায় অংশগ্রহণ করার চেয়ে এইসব পীরের মোকামে উপাসনা করাকেই বিশেষ পছন্দ করতেন । আবার হিন্দুদের কাছেও এই মোকামগুলি ছিল আকাঙ্খা ও ইচ্ছাপূরণের প্রার্থনাস্থল । মঙ্গলকাব্য তো বটেই , অন্যান্য ছড়া-পাঁচালি-গান ইত্যাদিতেও দেখা যায় অধিকাংশ হিন্দু কবিরাই তাঁদের রচনায় বাংলার পীর ও তাদের ধর্মীয় আশ্রমের কথা উল্লেখ করে বন্দনা গান করেছেন ,-
উত্তরে বন্দনা গো করলাম কৈলাশ পরবত ।
যেখানে পড়িয়া গো আছে আলির মালামের পায়থর ।।
পশ্চিমে বন্দনা গো করলাম মক্কা এন স্থান ।
উড়দিশে বাজায় সেলাম জমিন মুসলমান ।।
সভা বইর‍্যা বইছ ভাইরে হিন্দু-মুসলমান ।
সভার চরণে আমি জানাইলাম সালাম । ।
আসলামে জমিনে বন্দলাম চান্দে আর সুরুয ।
আলাম কালাম বন্দম কিতাব আর কুরাণ ।।
(মহুয়া পালা)
শাসকবর্গের অত্যাচার এড়াতেও হিন্দুরা অনেকসময় পীর বা গাজীর শরণাপন্ন হয়েছেন । মদনের পালাতে দেখা যায় মেদনমল্ল পরগণার হিন্দু জমিদার মদন রায় বাদশাহী কর সময়মত দিতে না পারায় সুবেদার শায়েস্তা খাঁয়ের রোষ নজরে পড়েন । তখন বড় খাঁ গাজী তাঁকে এই বিপদ থেকে উদ্ধার করলে তিনি বিশেষ জাঁকজমকের সংগে গাজীর পূজার ব্যবস্থা করেন । অপরদিকে মির্জাফরের অসুস্থ অবস্থায় দেবী কিরিটেশ্বরীর চরণামৃত পানের কথা অনেক লোককবি উল্লেখ করেছেন । দরবেশ তাহের মামুদ সরকারের শিষ্য কৃষ্ণহরি তাঁর সত্যপীরের পাঁচালিতে ঈশ্বরের স্বরূপ বর্ণনা করেন এই বলে ,-
এক ব্রহ্ম বিনে আর দুই ব্রহ্ম নাই ।
সকলের কর্তা এক নিরঞ্জন গোঁসাই ।।
ব্রহ্মা-বিষ্ণু-মহেশ্বর যার নাম জপে ।
অনন্ত ব্রহ্মাণ্ড যার এক লোমকূপে ।।
যেই নিরঞ্জনের নাম বিসমিল্লা কয় ।
বিষ্ণু আর বিসমিল্লা কিছু ভিন্ন নয় ।।
নাথসাহিত্যে বিখ্যাত কবি শেখ ফয়জুল্লাও গাজীকে ব্রহ্মা-বিষ্ণু-মহেশ্বরের অভিন্ন মূর্তি রূপে কল্পনা করেছেন । স্কন্দপুরাণের রেবাখণ্ডেও সত্যপীর সত্যনারায়ণ নামে জায়গা করে নিয়েছেন এবং সেখানে তার পূজাপদ্ধতির কথাও বর্ণিত হয়েছে । ইসলাম ধর্মের নবী সম্বন্ধে এক মুসলমান গ্রামের মোকাদ্দাম একজন ধর্মপ্রচারককে জানিয়েছিলেন যে,নবীজী এক বাঙালি ব্রাহ্মণ পরিবারে জন্মগ্রহণ করেছিলেন। আবার যোগীরা এই নবীকে গোরখনাথের শিষ্য বলে মনে করতেন ।
( Cencus Report, 1911 ; Encyclopedia of Islam ,11,491 ; D.C.Sen , Chaitanya & His Age )
পাঁচালিকার আব্দুল গফুর কালুগাজী চম্পাবতীতে পাতালে বলির কণ্যাকে গাজীর জননী বলে উল্লেখ করেছেন ।কেতকাদাস ক্ষেমানন্দ তাঁর মনসামঙ্গল কাব্যে মনসার কোপ থেকে বাসর গৃহে লক্ষীন্দরকে বাঁচাতে শৈব চাঁদ সদাগরকে দিয়ে অন্যান্য রক্ষাকবচের সঙ্গে কোরাণও পাঠিয়েছিলেন । একই ঈশ্বরকে হিন্দু-মুসলমানের মধ্যে প্রত্যক্ষ্ করা কিংবা -
হিন্দুর দেবতা হইল মুসলমানের পীর ।
দুই কুলে লয়ে সেবা হইল জাহির ।।
এই সমন্বয় ও সম্প্রীতিই মধ্যযুগের মূল প্রাণের সুর,-
হেঁদু আর মুসলমান একই পিণ্ডের দড়ি ।
কেহ বলে আল্লাহ আর কেহ বলে হরি ।।
বিছমিল্লা আর ছিরিবিষ্টু একই কায়ান ।
দো যাঁকে করি দিয়ে পরভু রাম রহিম ।।
(মলুয়া পালা)
নাথধর্মতত্ত্ব আশ্রয়ে যে সাহিত্যধারা মধ্যযুগে গড়ে ওঠে তার মধ্যে গুরু ও মুর্শিদ বাদের প্রভাব লক্ষ্য করা যায় এধারার অন্যতম কবি শেখ ফয়জুল্লা তাঁর গোরক্ষবিজয় গ্রন্থের সূচনায় ঈশ্বরের বন্দনাগান করে বলেন,-
প্রথমে প্রণাম করি প্রভু করতার ।
নিয়মে সৃজিলা প্রভু সকল সংসার ।।
স্বর্গ মর্ত পাতাল সৃজিলা ত্রিভুবন ।
নানারূপে কেলি করে না জাএ লক্ষণ ।।
তবে প্রণমিয়া তান নিজ অবতার ।
নিজ অংশে করিলেক হইতে প্রচার ।।
শুকুর মাহমুদের গুপিচন্দ্রের সন্ন্যাস কাব্যের বন্দনায়ও একই সুর শোনা যায়,-
প্রথমে বন্দিব আমি নাম নিরঞ্জন ।
যাহাতে হইল ভাই যোগের সৃজন ।।
তবে বন্দিব সিদ্ধা হাড়িফা জলন্ধর ।
যোগ মধ্যে বন্দ সিদ্ধা গোর্খ হরিহর ।।
কানেফা বন্দিব আর বানিজে ভাদাই ।
মছলন্দি সিদ্ধা বন্দ নামেতে মিন্যাই ।।
এখানে মীননাথ হয়ে উঠলেন মছলন্দি পীর । আর ফয়জুল্লা মীননাথের কণ্ঠে অকুণ্ঠ চিত্তে উচ্চারণ করেন ,-
মোর গুরু মহাদেব জগত ঈশ্বর ।
গঙ্গা গৌরী দুই নারী থাকে নিরন্তর ।।
যার দুই নারী তার সাক্ষাতে দিগম্বর ।
হেনরূপে করে গুরু কেলি নিরন্তর ।
তান আছে গৃহবাস আহ্মি কোন হই ।
ভবে মোর একগতি শুন আমি কই ।।
রামায়ণ কাহিনীর জনপ্রিয়তা মুসলমান সমাজে যে কতখানি প্রবল ছিল , রাজসভার পৃষ্টপোশকতার বাইরে অসংখ্য কবির রচনায় তার প্রমাণ রয়েছে । সাদেক আলীর রামচন্দ্রের বনবাস এর এক উল্লেখযোগ্য নিদর্শন । মুহম্মদ খান হিন্দু ধর্মতত্ত্ব নিয়ে রূপকাশ্রয়ে রচনা করেন সত্য কলি বিবাদ সম্বাদকাব্যমধ্যে কলিযুগের লক্ষণ বর্ননা করতে গিয়ে মুহাম্মদ তাঁর চারপাশের বাস্তব জগতের চালচিত্রকেই তুলে ধরেছেন ,-
বৃদ্ধ হৈব নির্লজ্জ বালকে না মানিবে ।
গুরুজন বলি কেহ মান্য না করিবে ।।
সাধু সব কপটে হরিব পর বিত্তি ।
ধনদান না করিব না অর্জিত কীর্ত্তি ।।- ইত্যাদি
অনেক মুসলমান কবি হিন্দু কর্মফলবাদকেও স্বীকার করেছেন।যেমন মর্দনের নছিরনামা য় আছে ,-
দেখ দেখ জার জেই আছে কর্মভোগ ।
সেই মতে কর্মফলে ভুঞ্জে দুঃখ সুখ ।।
হিন্দু যোগতন্ত্রের আশ্রয় গ্রহণ করে সৃষ্টিরহস্য , শূন্যরহস্য ও শূক্ররহস্য প্রভৃতি বিষয়েও বিভিন্ন মুসলমান কবিরা তাঁদের কাব্য রচনা করেছেন । তালিবনামা গ্রন্থে শেখচান্দ বলেন ।-
এ সব রঙ্গের জন্ম ছেহা জন্ম হোতে ।
ভাঙ্গিয়া সকল রঙ্গ মিশিব ছেহাতে ।।
আদ্যেত আছিল প্রভু শূন্যের শরীর ।
ছেয়া রঙ্গে নিজ অঙ্গে হইলেন্ত স্থির ।।
সৃষ্টিতত্ত্বের ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে কবিরা বলেছেন মহম্মদ , নিরঞ্জন আর ব্রহ্মা সকলেরই সৃষ্টি এক উৎস থেকে । ঘর্মসিক্ত নূরের বাম কণ্ঠ থেকে এক বিন্দু ঘাম ঝড়ে পড়ল , আর সেই ঘাম থেকে ,-ব্রহ্মা পয়দা তখন হৈল । ত্রিবেণীর ঘাটে নিত্য স্নান মহাপূণ্যপ্রদ । আব , আতস , বাত প্রভৃতি উপাদান সমূহ এবং ইড়া-পিঙ্গলা প্রভৃতি থাকা সত্ত্বেও প্রাণ দেহ ছেড়ে চলে যায় । কবিদের বিশ্বাস, সাধনার ফলে সিদ্ধিলাভ করতে না পারলে মৃত্যুকে এড়ানো যাবে না । মুসলমান কবিদের এই ধারণার পেছনে হিন্দু মতবাদের পাশাপাশি সুফিতত্ত্ব ও মরমিয়াবাদের প্রভাবটিও প্রবল ছিল । পণ্ডিতদের অনুমান এই যে পারস্যের সুফীধর্মের যোগপদ্ধতি বাংলাদেশে এসে কামরূপের তান্ত্রিক ব্রাহ্মণ ভোজবর্মণ রচিত সংস্কৃত যোগশাস্ত্রের গ্রন্থ অমৃতকুম্ভ দ্বারা প্রভাবান্বিত কুলকুন্ডলিনি শক্তিকে এই সুফীরা লতিফা এবং ষড়দল পদ্মকে বড়লতিফা বলে উল্লেখ করেছেন । সাধনতত্ত্বের বর্ণনায়ও হিন্দু যোগতাত্ত্বিকদের পদানুসরণ করেছেন ,-
ধ্বনি মূলে ব্রহ্ম নাম বায়ুর সঙ্গতি।
সেই নাম পবনে চলএ প্রতিনিতি ।।
সেই ধ্বনি পরমহংস কহে সিদ্ধাগণ ।
হংসনাম তেজেত নির্মল তন মন ।।
* * *
পূরক রেচক সঙ্গে হৃদের কম্পনে ।।
পূরক রেচক সঙ্গে রাখি মহাহংস ।
এক যোগে সাধনে সে শরীর নহে ধ্বংস ।।
এই জ্ঞানমার্গীয় মরমিয়া সুফিবাদ আর চৈতন্যোত্তর সহজিয়া বৈষ্ণব ধর্মই পরবর্তী সময়ে বাউল ধর্মের সুত্রপাত ঘটিয়েছিল।বৈষ্ণব সহজিয়াদের মত বাউলেরাও তাঁদের ধর্মপ্রবর্তক হিসেবে নিত্যানন্দ পুত্র বীরভদ্রের নাম উল্লেখ করে থাকেন । বীরভদ্রের শিক্ষামূলক কড়চা নামে একটি গ্রন্থে বৈষ্ণব ও ইসলাম ধর্মের সমন্বয় সূত্রও নির্দেশ করা হয়েছে । এই গ্রন্থে মহাপ্রভু নিত্যানন্দ তাঁর পুত্রকে মদিনা গিয়ে হজরতের গৃহে মাধববিবির কাছে দীক্ষা গ্রহণ করতে নির্দেশ দিয়েছেন এই বলে ,-
শীঘ্র করে যাহ তুমি মদিনা শহরে ।
যথায় আছেন বিবি হজরতের ঘরে ।।
তথায় যাই শিক্ষা লহ মাধববিবির সনে ।
তাহার শরীরে প্রভু আছেন বর্তমানে ।।
মাধব বিবি বিনে তোর শিক্ষা দিতে নাই ।
তাঁহার শরীরে আছেন চৈতন্য গোঁসাই ।।
হিন্দু ও মুসলমান এই উভয় সম্প্রদায়ের মিলিত সাংস্কৃতিক ঐতিয্যের পরিচয়বাহী অন্যতম সাধনা হল দরবেশ-পীর সাধনা । দরবেশ শাখাভূক্ত তাত্ত্বিক মাধক আলীরাজা হিন্দু তন্ত্র ও যোগশাস্ত্রে অভিজ্ঞতার দরুণ মুসলমানের সংগে সংগে অনেক হিন্দুকেও আকৃষ্ট করেছিলেন । তিনি হিন্দু গুরুবাদের একনিষ্ট ভক্ত ছিলেন । কবি সৈয়দ সুলতানও গুরুর চরণ স্মরণ করে দেহবাদী সাধনায় আত্মমগ্ন হয়ে নানাবিধ পদ রচনা করেছেন । আলীরাজাও একইভাবে গুরুর আরাধনা করেছেন ,-
গুরুর চরণ মূলে থাকি আলীরাজা বলে
রাধা হোন্তে নহে কানু দূরে ।
সৈয়দ সুলতান আক্ষেপ করেন ,-
নামে নহি ব্রাহ্মণ জ্ঞানে নহি পণ্ডিত
ধ্যানে নহি পরম যোগী ।
শুনিয়া গুরুর বানী স্থির নহে মোর প্রাণী
মনে লয় হৈই যাম বৈরাগী ।।
সাধন পথ দ্রষ্টা এই গুরুই যে ইসলামের মুর্শিদ তারই প্রমাণ পাওয়া যায় সেরাজের একটি পদে ,-
কায়াসুদ্ধ্ব হয় জান মুর্সিদ ভজিলে ।
লাঠি লৈক্ষে চলে যেন আন্দিয়াল সকলে ।।
মুর্সিদ প্রসাদে হয় আখিঁর প্রকাশ ।
মিহির কিরণে যেন উজ্জ্বল আকাশ ।।
মুসলমান লোককবিরা যে শুধুমাত্র হিন্দু ও ইসলাম এই উভয় ধর্মের সাম্য সন্ধানেই রত ছিলেন তা নয়, বরং ধর্মত্যাগী হওয়া সত্ত্বেও অনেকক্ষেত্রে ভক্তি ও শ্রদ্ধা সহকারে আদর্শ বৈষ্ণবোচিত গুণাবলী নিয়ে পদসাহিত্য রচনায় মনোনিবেশ করেছিলেন । অমিয় নিমাইর প্রেম ফল্গুধারা তাঁদের চেতনাকে উজ্জীবিত করেছিল । এই বৈষ্ণব ভাবাপন্ন মুসলমান কবিরা বৈষ্ণব ভক্তিবাদ ও মরমিয়া সুফিবাদকে এক করে ফেলেছিলেন । ইসলাম ধর্মে আল্লাহ যেখানে প্রভু, মানুষ সেখানে বান্দা বা দাস । কিন্তু সুফীদের কাছে সৃষ্টিকর্তার সঙ্গে সৃষ্টির সম্পর্ক প্রেমের , প্রভু-ভৃত্যের নয় । তাই মুসলমান কবিরা সহজেই রাধাকৃষ্ণের জীবাত্মা-পরমাত্মা ভাব স্বরূপকে আশেক-মাশুকের সঙ্গে একাকার করে নিয়েছিলেন । অনেকসময় তাঁরা তাঁদের ধর্মীয় প্রবক্তাদেরও শ্রী কৃষ্ণের মধ্যে উপলব্ধি করেছিলেন । বদিউজ্জামাল তাই অকপটে বলেন ,-
সবে বলে কালারে কালা আমি বলি শ্যাম ।
কালার ভিতরে লুকাই রে রইছে মওলার নিজ নাম ।
আসমান কালা জমিন রে কালা কালা পবন পানি ।
চাঁদ কালা সূর্যরে কালা , কালা মাওলাজি রব্বানি ।।
সুফীপ্রভাবে মুসলমান কবিরা ঈশ্বরকে রাধা বলে সম্বোধন করতে চাইলেও অনেকসময় মৌলবীদের চোখরাঙানো এতে বাধা হয়ে দাঁড়াত , সেই বাস্তব ছবিটি ধরা পড়েছে বামন উদাসের পদে ,-
হিন্দুরা বলে তোমায় রাধা , আমি বলি খোদা রাধা বলিয়া ডাকিলে মুল্লামুন্সিতে দেয় বাধা ।।
বৈষ্ণবীয় স্বকীয়া-পরকীয়া তত্ত্বও তাদের অগোচর ছিলনা ,-
স্বকীয়ার সঙ্গে নহে অতি প্রেমরস ।
পরকীয়া সঙ্গে যোগ্য প্রেমের মানস ।।
এই কবিরা রাধাকৃষ্ণের অনুরাগ এবং বিশ্বের স্বরূপ বর্ণনার মাধ্যমে একেশ্বরবাদেরও প্রচার করেছেন,- এক কায়া এক ছায়া নাহিক দোসর ।
এক তন এক মন আছে একেশ্বর ।।
ত্রিজগত এক কায়া এক করতার
এক প্রিভু সেবে জপে সব জীবধর ।।
বৈষ্ণব সহজিয়ারা যাকে পরমপুরষ বলেছেন , বাউলদের কাছে তিনিই হলেন সাঁই , আর মুসলমান বাউলদের কাছে তিনিই হলেন আলেখ নূরফকির সাধক সৈয়দ মর্তুজা মুসলমান বাউল হয়েও হিন্দুরই মতো পরমপুরুষকে সাঁই বলে সম্বোধন করে তাঁর সংগে ব্রহ্মা-বিষ্ণু-মহেশ্বরের অভিন্নতার কথা উল্লেখ করেছেন ,- সাঁই একবিনে মাওলা একবিনে আর নাহি কোই।
আরেক সমন্বয়বাদী কবি মহম্মদও বৈষ্ণব ধর্মের হ্লাদিনী শক্তির স্বরূপ অনায়াসে ব্যক্ত করেন,-
আল্লা মহম্মদ রাধাকৃষ্ণ একাঙ্গ একাত্মা যার।
এক হাতে বাজে না তালি এক সুরের কথা বলি
নীরে ক্ষীরে চলাচলি বীজের এই বিচার ।
পিতা আল্লা মাতা আহ্লাদিনী মর্ম বোঝা হল ভার ।।
মুসলমান কবিদের সাহিত্য ও সংস্কৃতি চর্চায় সম্প্রীতি গড়ে তোলার যে প্রয়াস দেখা যায় তা সেকালে হিন্দু কবিদেরও ইসলাম বিষয়ক কাব্য , কবিতা ও সঙ্গীত রচনায় উৎসাহিত করেছিল । যদিও এই প্রয়াসের চেষ্টা সীমিতই ছিল । প্রথাগত সাহিত্যচর্চা থেকে বেরিয়ে আসতে দেরী হলেও কিছু হিন্দু কবি-সাহিত্যিক নতুন যাত্রাপথের উদ্দেশ্যে পাড়ি জমাতে সমর্থ হয়েছিলেন এবং বাংলা সাহিত্যের আঙিনায় রাধাচরণ , মানিকদাস প্রমুখ কবিদের আবির্ভাব ঘটে । ধর্মীয় সংকীর্ণতার বন্ধন ছিন্ন করে মাণিকদাস আল্লার কাছে করুণা ভিক্ষা করে বলেন ,- আল্লা অন্তকালে কি বোল বুলিম নিজ ঘরে গিয়া কি হৈল কি হৈল মোরে দিয়া ।।
জেতের ফাতা বিকিয়েছে সাত বাজারে লালনের এই গানেও জাতিবর্ণভেদের উর্ধ্বে উদার মানবিকতা বোধের যে পরিচয় আমরা পাই সেই মানবধর্ম প্রচারই ছিল সেযুগের কাব্যসাহিত্য সাধনার এক বিশেষ আন্তরধর্ম । এই ধারাকেই আজও লালন করে চলেছে সাধারণ গ্রামীণ মানুষ তাদের হৃদয়ে ও ভাবপ্রকাশে । বিপন্ন সময় আর প্রতিকূল সংকটের মধ্যে এই পথই হল মুক্তির পথ । মধ্যযুগের কবিরা দ্বন্দ্ব-সংকটের মধ্যেও এই মানব প্রীতি ও ঐক্যবোধের সাধনার ধারাটিকেই প্রশস্ত করে তুলেছিলেন
·

No comments:

যাঁকে ঘিরে আমার অস্তিত্ব ...

যাঁকে ঘিরে আমার অস্তিত্ব ...