শিল্প ভাবনা





" শিল্পশাস্ত্র সমূহের দ্বারায় যজমান নিজের আত্মাকে ছন্দোময় করিয়া যথার্থ যে সংস্কৃতি তাই লাভ করেন এবং প্রাণের সহিত বাক্যকে , চক্ষুর সহিত মনকে , শ্রোত্রের সহিত আত্মাকে মিলিত করেন । " -- ।। বেদ ।।

কস্মিনকালেও শিল্পশাস্ত্রে আমার কোনো দক্ষতা ছিল না , শিল্পবুদ্ধি তো দূরস্থান । তা সত্ত্বেও দুঃসাহসী হতে সাধ যায় । প্রবৃত্তিজাত মন অসাবধানে পা ফেলে শিল্পের জগতে -- শিল্পভাবনায় । হঠাৎ হঠাৎ কোনো ছবি ভীষণ ভালো লেগে যায় , আবেগে মূর্চ্ছিত হয় হৃদয় । বিস্মিত মনের অপার আনন্দ রসের আস্বাদন লাভ করে । শিল্পতত্ত্বের ঊর্ধ্বে উঠে তখন মানব প্রবৃত্তিকে কুর্ণিশ জানাতে বড় ইচ্ছে যায় । এই প্রবৃত্তিই তো আদিম চিত্রকরের চিত্তবৃত্তিকে প্রথম চিত্রকর্মের দিকে আকর্ষণ করেছিল । সৃষ্টি হয়েছিল গুহাচিত্র ,শিলাপট , এমনকি নিত্যপ্রয়োজনীয় তৈজসপত্রেও লেগেছিল শিল্পের ছোঁয়া । এ যেন অকিঞ্চিতের মধ্যে সুন্দরের প্রাণপ্রতিষ্টার সাধনা -- অরূপকে রূপে ধরার প্রয়াস , আবার রূপকে রূপান্তরিত করার চেষ্টাও । শিল্পসাধনাই তো শিল্পীকে প্রতিস্থাপন করে সৃষ্টির গভীরে , শিল্পী উপলব্ধি করতে পারেন বিধাতার সৃষ্টির স্বরূপ ।

" পৃথক পৃথক ক্রিয়াভির্হি কলাভেদস্তু জায়তে । " ।। শুক্রনীতিসার ।।
পৃথক পৃথক ক্রিয়াকে অবলম্বন করেই বিভিন্ন কলার প্রকাশ ঘটে । কেউ নিরেট পাথরকে প্রাণদান করছে তো কেউ মাটি নিয়ে খেলছে সৃষ্টির খেলা । কাগজ-রং-তুলি তো আছেই । শিল্পের এই বিভিন্ন ধারা প্রতিনিয়ত আমাদের জীবনকেও করে তোলে শিল্পিত । সৃষ্টির সেই কোন আদিম লগ্নে মানুষ নিজের প্রয়োজনে তৈরি করেছিল মাটির হাঁড়িকুড়ি । কিন্তু মানুষ শুধু প্রয়োজন নিয়ে বাঁচেনা , তাঁর জীবনে চাই সুন্দরের ছোঁয়া । তাই খাবার তৈজসপত্রেও উঠে আসে কারুকার্য -- নকশা । ক্ষুধার নিবৃত্তি হয় -- সেইসঙ্গে তৃপ্ত হয় রূপদৃষ্টি , মনন ও সৌন্দর্যভাবনা । ব্যবহারিক জীবনের প্রতিটি বস্তুতে এভাবে ধীরে ধীরে শিল্পের ছোঁয়া লাগে , আরো পারিপাট্যে পূর্ণ হয় তার প্রেরণা ও কৌশল ।

ভাষায় আবেগ প্রকাশের অনেক আগেই আমরা আশ্রয় নিয়েছিলাম চিত্রভাষার । গুহাচিত্র এর প্রমাণ । না বলা কথা চিন্তা ও ভাবনাকে মানুষ সবসময়ই মুক্তি দিয়েছে তাঁর সৃষ্টির মাধ্যমে । সুর কবিতা ছবি গান এর এক একটা মাধ্যম মাত্র । স্রষ্টার সৃষ্টির আনন্দ স্বরূপকে মানুষ এভাবেই আত্মস্থ করতে চেয়েছে । শিল্পের বিভিন্ন মাধ্যম বাস্তব জীবনকে অবলম্বন করে সৃষ্টি করে এক বস্তুনিরপেক্ষ মায়ার জগৎ -- যা আমাদের নিয়ে যায় এক ' ঘন-আনন্দ-স্বরূপ ' চেতনায় , উপনিষদের আদর্শে এই চেতনাকে ব্রহ্ম আস্বাদের সহোদর বলে উল্লেখ করা হয়েছে । এর চর্চা আমাদের দিব্য দৃষ্টি উন্মুক্ত করে , চোখের সামনে খুলে দেয় অলৌকিক দ্বার । সৌন্দর্যের নিবিড়তর পাঠে হৃদয় পরিশীলিত হয় । মানুষ সাধনার দ্বারা উপলব্ধি করে শিল্পের রস ।

চিত্রভাষা সবার সঙ্গে কথা বলেনা । ওই যে বললাম , সৃষ্টির যে কোনো ধারাকে হৃদয়ঙ্গম করতে হলে চাই সাধনা -- চর্চা । কাব্যচর্চায় একটা কথা আছে যে রস হচ্ছে ' সহৃদয়হৃদয়সংবাদী ' । অর্থাৎ , কাব্যচর্চার মূল লক্ষ্য যে রস তা কিন্তু সবার কাছে সহজে ধরা দেয় না । একমাত্র কাব্যচর্চা এবং অনুশীলনের মাধ্যমে যাদের মন রসাস্বাদ গ্রহণের উপযুক্ত অর্থাৎ সহৃদয় হয়ে উঠে তেমন লোকই এর আস্বাদ লাভ করতে পারে । সহৃদয় লোকের হৃদয়ের বাইরে রসের আর কোনো স্বতন্ত্র আত্মা বা অস্তিত্ত্ব নেই । তেমনি শিল্প ভাষাও বিনা সাধনায় আমাদের সঙ্গে কথা বলে না । সব ভাষারই নিজস্ব ব্যাকরণ অলঙ্কার থাকে । সেই তত্ত্বের চর্চায় না গিয়েও যদি শুধুমাত্র সহৃদয়হৃদয়সংবাদী অলৌকিক মনন দ্বারা আমরা চিত্রভাষার আত্মার স্বরূপকে অনুধাবন করার চেষ্টা করি , তাহলে হয়ত আমাদের মতো সাধারণ শিল্পরসিকদের কাছে চিত্রভাষার আনন্দময় রূপ হৃদয়- ভাবনায় সহজেই ধরা দেবে ।

No comments:

যাঁকে ঘিরে আমার অস্তিত্ব ...

যাঁকে ঘিরে আমার অস্তিত্ব ...