ছিন্নমূল ও উত্তরাধিকার



ছেলেবেলায় বাবা গল্প বলতেন । পূজোর ছুটিতে করিমগঞ্জ থেকে নৌকো করে বাংলাদেশের সেই কোন পঞ্চখন্ডের খসি গ্রামে যাবার গল্প । তখনও ভারত ভাগ হয়নি । দাদু চাকরী করতেন করিমগঞ্জের মুন্সেফ কোর্টে । আর বাবারা ক'ভাই পড়াশোনার জন্য থাকতেন তাঁর সঙ্গে । স্কুল ছুটি হলেই সবাই মিলে বাড়ির উদ্দেশ্যে নৌকোযাত্রা । নদীপথে দুরাত্তিরের যাত্রা । মাঝপথে নদীতীরে মাঝিদের রান্নার গল্প বলতে বলতে বাবার চোখ চিক চিক করে উঠত । বাড়ির ঘাটে পৌঁছে ফলবাগান আর চানের পুকুর , খাবার জলের পুকুর , ' রাইয়ত ' -দের আলাদা খাবার জলের পুকুর পেরিয়ে তবে না বিশাল ঠাকুরদালানে পৌঁছোনো -- ঘরে ফেরা । আমার কাছে তখন বাবার সেই বাড়ি মানেই চারপাশে ছড়িয়ে থাকা পুকুরের মাঝখানে এক বিশাল বাড়ি । বাবা আজীবন তাঁর সেই বাড়ির গল্প করে গেছেন । ফলবাগানের কথা , মাছ ধরা , রকমারি খেলাধূলা , দূর্গাপূজার আনন্দ উৎসব , ' রাইয়ত '- দের গল্প -- এগুলো ছিল তাঁর প্রিয় বিষয় । আর একটা গল্প বাবা খুব বলতেন । ভারতবর্ষ স্বাধীন হবার দিনের গল্প । কিছুদিন থেকেই কানাকানি শোনা যাচ্ছিল করিমগঞ্জ নাকি জুড়ছে পূর্ব পাকিস্থানের সঙ্গে । যথারীতি ভারত স্বাধীন হবার একদিন আগেই করিমগঞ্জে স্বাধীনতা এলো । দেশটা হয়ে গেল পাকিস্থান । বাবারা আগেই বাড়ির মহিলাদের শিলচরে জ্যেঠুর কাছে পাঠিয়ে নিজেরা ক'ভাই থেকে গিয়েছিলেন করিমগঞ্জে । স্বাধীনতা উৎসবের অঙ্গ হিসেবে সেদিন জকিগঞ্জে এক বিশাল ফুটবল ম্যাচ আয়োজিত হয়েছিল । বাবারা কয়েকজন আমন্ত্রিত হয়ে সেই ম্যাচ খেলতে গেলেন । অবশ্য পরে করিমগঞ্জ আবার ভারতের সঙ্গে জুড়ে গেলো । সে এক অন্য গল্প । যা বলছিলাম , এই গল্পগুলি বলতে বলতে বাবার চেহারাটা পাল্টে যেতে দেখেছি । গল্প বলার আনন্দের মাধ্যমে বাবা যেন ফিরে যেতেন তাঁর সেই স্মৃতির পুরোনো গ্রামে । ছেলেবেলায় এই গল্পগুলি ছিল আমার কাছে রূপকথার মত । অনেকবার শুনে শুনে গ্রামটির একটা ছবি মনের কোনে আঁকা ছিল । এখনও চোখ বুজে সেই ছবি স্পষ্ট দেখতে পাই । কিন্তু একই গল্পের পুনরাবৃত্তিতে বড় হয়ে মুগ্ধতা হারিয়ে গেলো । তখন বিরক্ত হতাম । কিন্তু এই প্রসঙ্গে বাবার উৎসাহে কোনোদিন ঘাটতি চোখে পড়েনি ।যতবার এই এক গল্প বলতে শুরু করেছেন , ঠিক প্রথমবারের উৎসাহ নিয়েই শুরু করেছেন ।

আজ বাবা নেই । আমরা এখন বড় হয়ে গেছি । তখন বুঝতে পারিনি , আজ বাবার ছিন্নমূল আত্মার মানসিক কষ্টকে উপলব্ধি করি। তবুতো বাবাকে উদ্বাস্তু হতে হয়নি , কিন্তু শেকড়টা উপড়ে ফেলতে হয়েছিল বৈকি । আজ যখন নিজের শেকড়টা উপড়ে ফেলে চলে আসতে হয়েছে অন্য এক নতুন পরিবেশে , তখন কোথায় যেন বাবার কষ্টের সঙ্গে নিজের কষ্টটা একাত্ম হয়ে যায় । বাবার মতো আমার দেশটা পালটে যায়নি ঠিকই , এমনকি আছি একই রাজ্যে -- তবু কেনো সইতে হয় এই শেকড় উপড়ানোর যন্ত্রনা !!! নতুন করে শেকড় চাড়িয়ে দিতে পারিনি বলে ? এ কোন উত্তরাধিকার ! কালপ্রবাহে এখন আমি বাবার ভূমিকায় । আমার ছোট ছেলে যথেষ্টই ছোটো । বড় ছেলেকে গল্প শোনাই আমার সেই মাতৃশহরের । সে এখন মুগ্ধ হয়ে শোনে । অভিজ্ঞতা থেকে জানি ওর সেই মুগ্ধতা বেশীদিন নয় । কিছুদিন পরে বিরক্ত হবে । তাতে আমার উৎসাহ কমবে কী ? এবং স্মৃতি । এখন পুরাতন এবং প্রচলিত সেই সত্যিকে অবলম্বন করার সময় হয়েছে -- নতুনকে আঁকড়ে ধরাই জীবনশিল্প । মন ঘোরাতে নতুন পরিবেশের ভালো সবকিছুর কথা ভাবি । আরো অনেকগুলো বছর এখানে থাকতে হবে যে ! মন ভালো রাখার এ এক উপায় । কিন্তু ' মন কি অত সহজ ব্যাপার ' !!!!!!!


( বাবার ভীষণ ইচ্ছে ছিল তাঁর সেই পুরোনো গ্রামকে ফিরে দেখার । কিন্তু ভৌগলিক বাঁধা তাঁর এই ইচ্ছেপূরণের অন্তরায় ছিল । অল্প আয়াসে হয়ত সেই অন্তরায় কাটিয়ে উঠা সম্ভব হত । কিন্তু তা আর হয়ে উঠেনি । আজ বাবার সেই একান্ত ইচ্ছে গোপনে নিজের মনে বহন করে চলি -- যদি একবার অন্তত সেই ' পুকুর ঘেরা গ্রামটিকে ' দেখে আসা যায় !!! )

শিল্প ভাবনা





" শিল্পশাস্ত্র সমূহের দ্বারায় যজমান নিজের আত্মাকে ছন্দোময় করিয়া যথার্থ যে সংস্কৃতি তাই লাভ করেন এবং প্রাণের সহিত বাক্যকে , চক্ষুর সহিত মনকে , শ্রোত্রের সহিত আত্মাকে মিলিত করেন । " -- ।। বেদ ।।

কস্মিনকালেও শিল্পশাস্ত্রে আমার কোনো দক্ষতা ছিল না , শিল্পবুদ্ধি তো দূরস্থান । তা সত্ত্বেও দুঃসাহসী হতে সাধ যায় । প্রবৃত্তিজাত মন অসাবধানে পা ফেলে শিল্পের জগতে -- শিল্পভাবনায় । হঠাৎ হঠাৎ কোনো ছবি ভীষণ ভালো লেগে যায় , আবেগে মূর্চ্ছিত হয় হৃদয় । বিস্মিত মনের অপার আনন্দ রসের আস্বাদন লাভ করে । শিল্পতত্ত্বের ঊর্ধ্বে উঠে তখন মানব প্রবৃত্তিকে কুর্ণিশ জানাতে বড় ইচ্ছে যায় । এই প্রবৃত্তিই তো আদিম চিত্রকরের চিত্তবৃত্তিকে প্রথম চিত্রকর্মের দিকে আকর্ষণ করেছিল । সৃষ্টি হয়েছিল গুহাচিত্র ,শিলাপট , এমনকি নিত্যপ্রয়োজনীয় তৈজসপত্রেও লেগেছিল শিল্পের ছোঁয়া । এ যেন অকিঞ্চিতের মধ্যে সুন্দরের প্রাণপ্রতিষ্টার সাধনা -- অরূপকে রূপে ধরার প্রয়াস , আবার রূপকে রূপান্তরিত করার চেষ্টাও । শিল্পসাধনাই তো শিল্পীকে প্রতিস্থাপন করে সৃষ্টির গভীরে , শিল্পী উপলব্ধি করতে পারেন বিধাতার সৃষ্টির স্বরূপ ।

" পৃথক পৃথক ক্রিয়াভির্হি কলাভেদস্তু জায়তে । " ।। শুক্রনীতিসার ।।
পৃথক পৃথক ক্রিয়াকে অবলম্বন করেই বিভিন্ন কলার প্রকাশ ঘটে । কেউ নিরেট পাথরকে প্রাণদান করছে তো কেউ মাটি নিয়ে খেলছে সৃষ্টির খেলা । কাগজ-রং-তুলি তো আছেই । শিল্পের এই বিভিন্ন ধারা প্রতিনিয়ত আমাদের জীবনকেও করে তোলে শিল্পিত । সৃষ্টির সেই কোন আদিম লগ্নে মানুষ নিজের প্রয়োজনে তৈরি করেছিল মাটির হাঁড়িকুড়ি । কিন্তু মানুষ শুধু প্রয়োজন নিয়ে বাঁচেনা , তাঁর জীবনে চাই সুন্দরের ছোঁয়া । তাই খাবার তৈজসপত্রেও উঠে আসে কারুকার্য -- নকশা । ক্ষুধার নিবৃত্তি হয় -- সেইসঙ্গে তৃপ্ত হয় রূপদৃষ্টি , মনন ও সৌন্দর্যভাবনা । ব্যবহারিক জীবনের প্রতিটি বস্তুতে এভাবে ধীরে ধীরে শিল্পের ছোঁয়া লাগে , আরো পারিপাট্যে পূর্ণ হয় তার প্রেরণা ও কৌশল ।

ভাষায় আবেগ প্রকাশের অনেক আগেই আমরা আশ্রয় নিয়েছিলাম চিত্রভাষার । গুহাচিত্র এর প্রমাণ । না বলা কথা চিন্তা ও ভাবনাকে মানুষ সবসময়ই মুক্তি দিয়েছে তাঁর সৃষ্টির মাধ্যমে । সুর কবিতা ছবি গান এর এক একটা মাধ্যম মাত্র । স্রষ্টার সৃষ্টির আনন্দ স্বরূপকে মানুষ এভাবেই আত্মস্থ করতে চেয়েছে । শিল্পের বিভিন্ন মাধ্যম বাস্তব জীবনকে অবলম্বন করে সৃষ্টি করে এক বস্তুনিরপেক্ষ মায়ার জগৎ -- যা আমাদের নিয়ে যায় এক ' ঘন-আনন্দ-স্বরূপ ' চেতনায় , উপনিষদের আদর্শে এই চেতনাকে ব্রহ্ম আস্বাদের সহোদর বলে উল্লেখ করা হয়েছে । এর চর্চা আমাদের দিব্য দৃষ্টি উন্মুক্ত করে , চোখের সামনে খুলে দেয় অলৌকিক দ্বার । সৌন্দর্যের নিবিড়তর পাঠে হৃদয় পরিশীলিত হয় । মানুষ সাধনার দ্বারা উপলব্ধি করে শিল্পের রস ।

চিত্রভাষা সবার সঙ্গে কথা বলেনা । ওই যে বললাম , সৃষ্টির যে কোনো ধারাকে হৃদয়ঙ্গম করতে হলে চাই সাধনা -- চর্চা । কাব্যচর্চায় একটা কথা আছে যে রস হচ্ছে ' সহৃদয়হৃদয়সংবাদী ' । অর্থাৎ , কাব্যচর্চার মূল লক্ষ্য যে রস তা কিন্তু সবার কাছে সহজে ধরা দেয় না । একমাত্র কাব্যচর্চা এবং অনুশীলনের মাধ্যমে যাদের মন রসাস্বাদ গ্রহণের উপযুক্ত অর্থাৎ সহৃদয় হয়ে উঠে তেমন লোকই এর আস্বাদ লাভ করতে পারে । সহৃদয় লোকের হৃদয়ের বাইরে রসের আর কোনো স্বতন্ত্র আত্মা বা অস্তিত্ত্ব নেই । তেমনি শিল্প ভাষাও বিনা সাধনায় আমাদের সঙ্গে কথা বলে না । সব ভাষারই নিজস্ব ব্যাকরণ অলঙ্কার থাকে । সেই তত্ত্বের চর্চায় না গিয়েও যদি শুধুমাত্র সহৃদয়হৃদয়সংবাদী অলৌকিক মনন দ্বারা আমরা চিত্রভাষার আত্মার স্বরূপকে অনুধাবন করার চেষ্টা করি , তাহলে হয়ত আমাদের মতো সাধারণ শিল্পরসিকদের কাছে চিত্রভাষার আনন্দময় রূপ হৃদয়- ভাবনায় সহজেই ধরা দেবে ।

বর্ষামঙ্গল




... বাঁধন-হারা বৃষ্টি ধারা ঝরছে রয়ে রয়ে

অবশেষে আষাঢ়স্য প্রথম দিবসে সত্যিই বর্ষা নামল । আমাদের এই ছোট্ট শহরে এ এক বিশাল পাওনা । বিধাতার অভিশাপে মেঘেদের এখানে বিশ্রাম নেওয়াও বারণ । অতি কৌতুহলী উচ্ছ্বল দু-এক ফোঁটা বৃষ্টি ইতি-উতি উঁকি দিলেও হাওয়ার কড়া পাহারা মুহূর্তে তাদের তাড়িয়ে নিয়ে যায় । পাশের গ্রাম থেকে আসা সহকর্মী নিদাঘ-তপ্ত দুপুরে যখন বৃষ্টি ভেজা রাস্তার দুরবস্থার কথা শোনান অজান্তেই দীর্ঘশ্বাস পড়ে । ঝড়ের দিনে আম কুড়ানো , কোঁচড় ভর্তি করে শিল তোলা , এমনকি মেঘ গর্জনে ভীত-ত্রস্ত ( কে জানে হয়তো বা আহ্লাদিত ) কই মাছেরা ডাঙায় উঠে এলে অতি উৎসাহীদের মাছ ধরার ভীড় ( দুঃসাহসী এই কাজে নিজে কখনো যোগদান করার সাহস পাইনি ) -- সেইসব পুরোনো স্মৃতির ঝিলিক মনকে আচ্ছন্ন করে । সেই স্মৃতির শহর অবশ্যই অন্য এক ঠাঁই -- যার থেকে দূরে কর্মসূত্রে আপাতত অন্যত্র অবস্থান করতে হচ্ছে । সেই মাতৃশহর ঘিরে আছে খুব সুন্দর এক নদী -- কুশিয়ারা । ওপারে বাংলাদেশ । ছেলেবেলায় আমার কাছে নদীর ওপার মাত্রই বাংলাদেশ -- সে বরাকই হোক , কিংবা ব্রহ্মপুত্র । দেশের সীমা বোঝার বয়স না হওয়া অব্দি নদীতে নৌকো চড়তে পারতাম না বলে মনে একটা দুঃখ ছিল । আশ-পাশের আর দশটা গ্রাম-শহরেও একটা করে নদী । গাড়ীতে কোথাও ঘুরতে যাই তো পাশেপাশে পথ দেখিয়ে নদীও চলে । নদী এবং জনপদের এই পাশাপাশি অবস্থান শুধু স্বাভাবিক নয় , সত্য বলেই জানতাম । আর একটা মজার (অনেকের কাছেই দুঃখের ) ব্যাপার হলো আমাদের ওই অঞ্চলে গ্রীষ্ম বলে কোনো ঋতু ছিল না , এখনো নেই । এই ঋতুর পুরোটাই গ্রাস করেছে বর্ষা ।

এখানে আবার উল্টো । গ্রীষ্মদেবতার দেবোত্তর সম্পত্তিতে বর্ষার প্রবেশ নিষেধ । নদীও বুঝি ভয়ে এই পথ মাড়াতে ভুলে গেছে । স্বাভাবিক ভাবেই পয়লা আষাঢ়ে বর্ষার এই মঙ্গলধ্বনি হৃদয়ে পুলক জাগায় । বৃষ্টির ধূপ-গন্ধে সিক্ত হয় মন । নববর্ষার ধারাজলে মাটির গভীরে নামে শিকড় । রূপকথার আমেজে ভাসে মায়াবী শরীর । ফ্যাকাশে জীবনযাত্রা খুঁজে পায় অন্যতর জীবনের স্বাদ । ঘরে-ঘরে খিচুড়ির গন্ধ ছড়ায় । নর-নারী পরস্পরের মুখোমুখি বসে । নিভৃত জীবন জুড়ে জেগে থাকে বর্ষার গান -- বর্ষামঙ্গল ।

ঘুমভাঙা ভোর


অনেকদিন ধরে কিছু লিখি না । কখনও মনে হয় ফুরিয়ে গেছি । আবার না লেখার পেছনে যুক্তিও তো ঢের । সাজানো সেই যুক্তির জোর মনকে বেশ তৃপ্ত করে । তবুও শান্তি কই !! সেলাই করি । ঘর সাজাই । নতুন উদ্যমে কিছু করার কথা ভাবি । ছেলেদের দস্যিপনায় উত্তেজিত হই । আয়েস করে ঘন্টার পর ঘন্টা ঘুমাই । মাঝে-মাঝে বিষন্ন নির্জনে গাধার পিঠের বোঝার কথা মনে হয় । ছেলেদের আহ্লাদেপনায় নিজের ছেলেবেলা আরোও নিবিড় করে আঁকড়ে ধরে । আশৈশবের অভ্যেসগুলো গাঢ় মমতায় চর্চা করি । আবার ভাবি -- ধ্যাত্ , সবই তো ফাঁকি । এই ফাঁকটাকে পূর্ন করতে মনের ভেতর অনেক না বলা কথার ফেনাপুঞ্জ উথলে উঠে । এ বড় সহজ কষ্ট নয় । স্বপ্ন দেখি । বুকের গভীরে এর রেশ কিছুদিন বন্দী হয়ে থাকে । স্বপ্নরীতি পুরোনো হলে কল্পনায় আবাস গড়ি । যাত্রা চলতেই থাকে ।

এই যাত্রার গোলোক পথেই আবারও ফিরে আসি ' লেখা-না-লেখার ' জগতে । না বলা কথার উচ্ছল ধারাজলে তৈরি হয় শব্দের বেড়াজাল -- কবিতা । ভালোবাসা-ভালোলাগা তখন মিলেমিশে একাকার । খোলা জানালায় হাত বাড়ালেই মুঠোয় সমস্ত পৃথিবী । বুকের ভেতর গড়ায় আনন্দের দানা । সত্তার আনন্দই তো শেষ কথা -- তাই না ? আর কী চাই !!!!!!!

কবিতার জন্ম : কবির জন্মান্তর



"যখন বিষন্ন তাপে প্রধূম গোধূলি তার করুণাবসন ফেলে সূর্যমুখী পৃথিবীকে ঢাকে
কঠিন বিলাপে কাঁপে উপশিরা-শিরা , জ্যোতিষ্কলোকের রূপসীরা একে একে
ছিন্ন করে দয়িত-আকাশ , যখন প্রেমের সত্য ভুবনে ভুবনে ফেরে করুণ লেখায় ,
তুমিও আসন্ন চন্দ্রে মেলে দাও হৃদয় তোমার , আমি থরোথরো শীতে যন্ত্রনার
শিখা মেলি আতপ-তির্যক , যখন পৃথিবী কাঁপে মৃততেজা মুঠোতে আমার --

তখন কবিতা মিতা , প্রিয় থেকে প্রিয় সখী , সুহৃদ , সুন্দর ।"

-- ১১ জানুয়ারি । দুপুর : শঙ্খ ঘোষ ।



প্যারিসের এক হোটেল । পিকাসো দাঁড়িয়ে আয়নার সামনে । দাড়ি কামাচ্ছিলেন । আপোলিনেয়ারের মৃত্যুসংবাদ তখনই কানে এল । এক-দিগন্ত যন্ত্রনায় ভেঙ্গে গেল হৃদয় । সেইসঙ্গে মুখটাও । শূন্য দৃষ্টি আয়নায় পড়তেই চমকে উঠলেন শিল্পী । এ কার মুখ ? রেজার রেখে হাতে তুলে নিলেন কাগজ-পেনসিল । ব্যথিত হৃদয়-আর্তি আয়নায় প্রতিফলিত সেই দুমড়ে-মুচড়ে যাওয়া মুখচ্ছবিকে ক্যানভাসে রূপ দিতে লাগল । আত্মার আলোড়িত আবেগ জন্ম দিল এক যুগান্তকারী অমর সৃষ্টির । আত্মিক যন্ত্রনার এই শিল্পিত উত্তরণ শিল্পীকে দিল আবেগিক মুক্তি । কিউবিক রীতির এই আত্মপ্রতিকৃতি দ্বারা পিকাসো বন্ধুর মৃত্যুকে জানালেন বিনম্র শ্রদ্ধা । আর এই সৃষ্টির সূত্র ধরেই শিল্পীজীবনেও ঘটল জন্মান্তর -- 'এ ফেয়ারওয়েল টু ইয়ুথ ' । যৌবনের কল্পলোককে বিদায় জানিয়ে শিল্পী পা দিলেন প্রৌঢ়ত্বের শক্ত মাটিতে ।

জীবনে যা সত্য , শিল্প সেই সত্যেরই সংহত ও সুন্দর প্রতিভাস । কবিতাও এই সত্যের সারবস্তুকে গ্রহণ করে শোভন হয়ে উঠে এবং শিল্পিত উৎকর্ষতা লাভ করে । আত্মসত্তার সুখ-আহ্লাদ ,হর্ষ-পুলক , দুঃখ-যন্ত্রনা , আবেগ-দরদ , ব্যাথা-মনস্তাপ অনুভূতিশীল কবিকে সৃষ্টির এক প্রদীপ্ত উৎসের পথে চালিত করে । যতক্ষণ না কবিমননে আলোড়িত ভাবনার মুক্তি ঘটে ততক্ষণ কবিরও রেহাই নেই । প্রকাশের অবর্ণনীয় আনন্দ কবিকে দেয় প্রজাপতির সৃষ্টির স্বাদ । মনন-প্রতিচ্ছায়া সৃষ্টির এই প্রয়াস জন্মান্তরের এক অনন্য উপলব্ধি । কিন্তু কবিহৃদয় শুধু তৃপ্ত হয় না । সৃষ্টির স্বরূপ উদ্ভাসেও তিনি সমান যত্নবান । ' মা নিষাদ প্রতিষ্টাং ' উচ্চারণেই আদিকবির ক্রৌঞ্চবিরহের শোকাবেগ পরিতৃপ্তি লাভ করেনা । এরপরেও তাঁকে এই পাদবন্ধের স্বরূপ সম্পর্কে ভাবতে হয় । এভাবেই জন্ম হয় ' শ্লোক '-এর --শোকার্ত হৃদয়-আর্তির । শ্লোক ছন্দের তন্ত্রীতে আন্দোলিত কবিতারই প্রাচীন নাম । কবিমানসের পক্ষে ভাবযন্ত্রনা উপেক্ষা করা অসম্ভব । প্রকাশের যন্ত্রনাই তাঁর জীবনে আনে প্রকাশের অসীম আনন্দ -- দান করে মুক্তি । কাব্য সৃষ্টি লগ্নের এই যন্ত্রনা ' রক্তকে কালিতে রূপান্তরের যন্ত্রনা ' । এই যন্ত্রনার জন্ম আত্মার অতল গভীরে -- মরমী আবেগে । আত্মাভিমানের খোঁজে সৃষ্টির মহত্বে । শব্দ, চিন্তা আর বাক্যের অস্থি নিয়ে কবির আবেগ থেকে ভূমিষ্ট হয় কাব্যশরীর । তার থাকেনা কোনো ব্যাক্তিপরিচয় । নিজের অস্তিত্ত্বের উর্ধ্বে সর্বজনীনপরিচয়ই এর লক্ষ্য । কবিতার এই সার্বিক ব্যঞ্জনা সেই মহাকাব্যের যুগ থেকে কবিকে দিয়ে এসেছে নবজাতের সম্মান ।

কবির কাছে কবিতা ' সমস্ত জ্ঞানের শ্বাসপ্রশ্বাস আর সুক্ষ আত্মা ' । এই সুক্ষ আত্মার অবাধ সঞ্চরণেই কবিতা ঋদ্ধ হয়ে উঠে । এর অবারিত যাত্রা কবিকে এই বোধে পৌঁছে দেয় যে ' আমার জন্মের কোনো শেষ নেই ' । প্রতিটি নতুন কবিতার জন্ম কবিকে দেয় জন্মান্তরের আস্বাদ । এই আস্বাদ কবি অনুভূতির কাছে দাবী রাখে ' যেতে যেতে মনে রেখো পিছনে কী ছিল '। ভূত বর্তমান ভবিষ্যত ' প্রতিমুহূর্ত বাড়িয়ে দেয় হাত / সম্পর্কে আনন্দে দূর্বাজলে '।
কবির কাছে জীবনও ' দাবি করেছিল যেন প্রত্যেক মুহূর্তে তুমি কবি '। প্রত্যেক মুহূর্তে কবি হয়ে ওঠার দায়িত্ব কবিরা অস্বীকার করেন না । তাঁর ' না লেখা কবিতাগুলি' সবসময় তাঁকে ' সর্বাঙ্গ জড়িয়ে আদর করে ,চলে যায় ঘুরে ফিরে আসে ' । তিনি অনুভব করেন ' কবিতা লেখার চেয়ে কবিতা লিখবো লিখবো এই ভাবনা আরও প্রিয় লাগে ' । চোখে ' কবিতার সুখস্বপ্ন গাঢ় হয়ে আসে ' । তখন মেধা এসে ডেকে নিয়ে যায় কবিকে । কবিমুখে উচ্চারিত হয় সেই ধ্রুব স্বীকারোক্তি :

" কবিতার সত্যে আমি একঝলক মিথ্যের বাতাস
লাগাই , কী পালটে যায় কবিতার সত্য একদিনে
তাহলে সত্যের নেই সেই বুঝ , সেই দাঁড়সাঁতার ,
সত্য নয় শিশু , নয় রাজনীতি , নয় মুথা ঘাস । "

এই ' মিথ্যের বাতাস ' কবির রৌদ্র রূপালি হৃদয়ে প্রশ্ন রাখে ' কবিতার সার কথা নাকি সত্য , অথচ কবিরা সব মিথ্যুকের একশেষ নয়?' কবি সমাজের আত্মা নন । তিনি সেই ' sooth sayer ' এর ভূমিকাও পালন করেন না যে জুলিয়াস সিজারকে বলেছিল তাঁর দিন ফুরিয়ে এসেছে । কবির সত্য সমাজের দিগদর্শনের জন্যও সৃষ্টি হয় না। বাস্তবকে তিনি গ্রহণ করেন নিজের মত করে । কবি জানেন কবিতার আবেদন বুদ্ধি মেধা বা জ্ঞানের কাছে নয় -- এর আবেদন হৃদয়ের গহীনে । জীবনের মানুষের সংসারের প্রকৃতিজাত সারসত্যকে তিনি উদ্ভাসিত করে তোলেন তার একান্ত নিজস্ব বিশ্বাসের আলোকে । কবির বিশ্বাস বাস্তব সবসময় সত্যকে অনুসরণ নাও করতে পারে । ' কবিরা সবসময় সত্যদ্রষ্টা হয় না ' -- এই স্বীকারোক্তিকে সামনে রেখেই সুক্ষ্ম আত্মার বিচরণের অভিজ্ঞতায় কবি কাব্যসত্যকে রচনা করেন । তাঁর একটাই আশা , ' শব্দ তার প্রতিবিম্ব আমাকে দেখাবে বলেছিল '। এই প্রত্যয় নিয়েই চলে কবিতার সঙ্গে কবির নিত্য ঘরকন্না , জন্ম হয় নতুন নতুন কবিতার । এই প্রতিটি নতুন কবিতার মধ্যে অর্ন্তলীন থেকে যায় একটাই সত্য -- কবি যাকে খোঁজেন সারাজীবন ধরে । জন্ম হয় নতুন নতুন কবিতার । কবিমন উপলব্ধি করে :

' একটাই তো কবিতা
লিখতে হবে , লিখে যাচ্ছি সারা জীবন ধরে । '

আজীবন এই একটা কবিতার অনুশীলন করেই কবির পথচলা । এই পথচলা জীবনসত্যে উত্তরণের জন্য । এই সত্য কবিজীবনে এনে দেয় অলৌকিক আস্বাদ । সৃষ্টির অতৃপ্তি থেকে সৃষ্ট হয় প্রতিটি নতুন কবিতার । বাস্তব পরিপার্শ্ব তাঁর হৃদয়ে জাগায় তীব্র আলোড়ন । অন্য সব মানসিক কষ্ট থেকেও এই যন্ত্রনা দুঃসহ হয়ে উঠে । মননের আয়ু ঝড়িয়ে যতক্ষন না এই কষ্টকে কবি হৃদয় করতে নিংড়ে প্রকাশ করতে পারেন ততক্ষন তা কবিকে কুরে কুরে খায় । কিন্তু একবার তা কবিতাকারে প্রকাশ হয়ে যাবার পর এক অনিবর্চনীয় আনন্দ্রসে ডুবে যায় কবিমন । আত্মিক যন্ত্রনার পরিণাম এই সৃষ্টি কবিকে দেয় এক অনন্য অনুভূতি । যন্ত্রনার এই জন্মান্তরের আস্বাদ থেকেই কবি বারবার আশ্রয় খোঁজেন কবিতার ওমে । সৃষ্টির এই আতৃপ্তি কখনও পূর্ণ হবার নয় । অতৃপ্ত এই অনুভূতির অভাবে মৃত্যু ঘটে সৃষ্টির -- মৃত্যু হয় কবির । জীবনের আকাঙ্খায় কবিকে কবিতা সৃষ্টি করটি হয় । এভাবেই জন্ম হতে থাকে কবিতার -- কবির ঘটতে থাকে জন্মান্তর ।


( এই আলোচনায় ওয়ার্ডসওয়ার্থ , এলিয়ট , শক্তি চট্টোপাধ্যায় , শঙ্খ ঘোষ , সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় এবং জয় গোস্বামীর কবিতার অংশবিশেষ ব্যবহৃত হয়েছে । )

ভাউলিয়া


নদীকে আপন করা ছাড়া
উদাসীর আর কোনো চাওয়া-পাওয়া নাই
দরিয়ার পানি তাকে সাকিন ভোলায়
লাউডগা মন যায় ভিটে-মাটি ছেড়ে

শুরু হয় বাস্তুহীন প্রেম-প্রেম খেলা ...

তোমাকে ...




আমার সম্পদ শুধু একঘড়া জল --
এসো , ডুব দাও অতল গহীনে
তুলে আনো বিষন্ন ঝিনুক ।

আর সেই ঝিনুকবালা
ডাগর-ডোগর মেয়েটি , মুক্তো
হেসে উঠুক তোমার নাকে , নাকছাবিতে ...

যাঁকে ঘিরে আমার অস্তিত্ব ...

যাঁকে ঘিরে আমার অস্তিত্ব ...